( বাঁ দিক থেকে) মহুয়া মৈত্র, বিনোদ সোনকর, জয় অনন্ত দেহাদ্রাই। —ফাইল চিত্র।
যত ‘গরম’ বিষয়, তা নিয়ে ততটাই ‘সরগরম’ বৈঠক। কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে ‘টাকা ও উপহার নিয়ে প্রশ্ন’ তোলার অভিযোগে বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার প্রায় এক ঘণ্টা থমকে রইল লোকসভার এথিক্স কমিটির বৈঠক। বিরোধীরা এক যোগে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটির’ অভিযোগ তুলে দাবি করেন, বৈঠক বাতিল করতে হবে! পরিস্থিতি এমনই হয় যে, বৈঠক হবে কি না, তা নিয়ে ভোটাভুটি করতে হয়। তাতে আবার ৫-৫ ভোটে ফলাফল ‘টাই’ হয়। শেষ পর্যন্ত বিজেপি সাংসদ তথা কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ সোনকর নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করায় ফলাফল দাঁড়ায় ৬-৫। তার পরে বৈঠক শুরু হয়।
প্রথম দিনের বৈঠকে অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে ও মহুয়ার প্রাক্তন বন্ধু তথা আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাইকে ডেকে তাঁদের বক্তব্য শোনে কমিটি। সূত্রের খবর, বিরোধীদের প্রশ্নবাণে ‘জর্জরিত’ হতে হয় জয়কে। যদিও কমিটির চেযারম্যান প্রথম দিনের বৈঠকের পর তেমন কিছু জানাননি।
লোকসভার এথিক্স কমিটিতে মোট ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। চেয়ারম্যান বিনোদ ছাড়া ১০ জন উপস্থিত ছিলেন বৃহস্পতিবারের বৈঠকে। ওই ১০ জনের মধ্যে পাঁচ জন বিজেপির সাংসদ। বাকিদের মধ্যে দু’জন কংগ্রেস, এক জন নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড, এক জন সিপিআই এবং এক জন মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির সাংসদ। প্রসঙ্গত, সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’তে বিএসপি নেই। কিন্তু এথিক্স কমিটিতে ‘বহেনজি’র দলের সাংসদ সমানে-সমানে লড়ে গিয়েছেন বিরোধী শিবিরের হয়ে।
বৈঠক শুরুর সময়েই জয়কে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সামনেই বিরোধীপক্ষের এক সাংসদ চেয়ারম্যানকে বলেন, কেন আগে অভিযুক্তকে না ডেকে অভিযোগকারীদের কথা শুনতে চাইল কমিটি? কমিটির কাজে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ রয়েছে বলে সরব হন বিরোধীরা। তাঁরা বলেন, আগে এই বিষয়টির ফয়সালা করতে হবে। নইলে বৈঠক শুরু করা যাবে না। ততক্ষণ জয়কে বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। ঘণ্টাখানেক ধরে বিতণ্ডা চলে। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের তরফে বিষয়টি নিয়ে ভোটাভুটির প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভোটাভুটির পরে দেখা যায়, ফলাফল সমান: ৫-৫! তখন চেয়ারম্যান তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সেখানে সরকারপক্ষ জিতে যাওয়ায় বৈঠক শুরু হয়।
তখনই ঠিক হয়, মহুয়াকে পরে বৈঠকে ডাকা হবে। বৈঠকে উপস্থিত এক সাংসদের বক্তব্য, কবে পরের বৈঠক ডাকা যায়, চেয়ারম্যান তা জানতে চাইলে বিজেপির এক মহিলা সাংসদ বলেন, দীপাবলির (অর্থাৎ, ১২ নভেম্বরের পরে) পরে বৈঠক ডাকলে ভাল হয়। তবে চেয়ারম্যান তাতে রাজি হননি। তিনি জানান, ৩১ অক্টোবর পরের বৈঠক হবে। মহুয়াকে সেখানেই ডেকে পাঠানো হবে।
মহুয়া আগেই জানিয়েছেন, তিনি এথিক্স কমিটির ডাকের অপেক্ষা করছেন। সেখানে ডাক পেলে তিনি নিজের বক্তব্য জানাবেন।
তবে ওয়াকিবহালরা জানেন, সোনকর এমনিতেই এ সব ব্যাপারে বিলম্ব পছন্দ করেন না। তিনি যখন ত্রিপুরা বিজেপির পর্যবেক্ষক ছিলেন, তখনও বিপ্লব দেব-সুদীপ রায়বর্মনের কোন্দল মেটাতে তড়িঘড়ি বৈঠক ডাকতেন। কোনও কোনও বৈঠক হত মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিসে! বিরোধীপক্ষের অবশ্য বক্তব্য, চেয়ারম্যান যে ভাবে ‘তড়িঘড়ি’ বৈঠক ডাকতে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাতে তাঁর উপর ‘চাপ’ রয়েছে বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও সোনকর স্বয়ং এমন কোনও সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
ঘণ্টাখানেক পর বৈঠকে প্রবেশ করেন আইনজীবী তথা মহুয়ার প্রাক্তন প্রেমিক জয়। তাঁর কাছে এথিক্স কমিটির সদস্যদের একাংশ জানতে চান, তিনি যে অভিযোগ করেছেন, তার স্বপক্ষে তাঁর কাছে কী নথি রয়েছে? বৈঠকে উপস্থিত সূত্রের বক্তব্য, ওই একই প্রশ্ন জয়কে ঘুরিয়েফিরিয়ে ১৪ বার করা হয়। প্রতি বারই জয় বলেন, তাঁর কাছে কোনও নথি নেই। মহুয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। কুকুরের মালিকানা নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিবাদ হয়। তাঁর যা বক্তব্য তিনি তাঁর হলফনামাতেই বলেছেন।
জয় পোষ্য-প্রসঙ্গ তুলতে এথিক্স কমিটির এক সদস্য বলেন, কুকুর নিয়ে বিবাদের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের আইনসভার এথিক্স কমিটিকে বৈঠক করতে হচ্ছে, সেই বিষয়টি বৈঠকের কার্যবিবরণীতে নথিভুক্ত করা হোক। যাতে ভবিষ্যতে লোকে বিষয়টি জানতে পারেন। শেষ পর্যন্ত তা কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ হয় বলে জানা গিয়েছে।
কমিটি সূত্রের খবর, জয়কে প্রশ্ন করা হয়, তাঁর অভিযোগ সম্বলিত চিঠিটি কী করে একমাত্র নিশিকান্তের হাতেই পৌঁছল? যদি না তিনি নিজে সেটি বিজেপির সাংসদকে দিয়ে থাকেন? কমিটির এক সদস্য জানান, জয় দাবি করেন, তিনি নিশিকান্তকে চেনেন না! কমিটির বিরোধীপক্ষের সদস্যেরা তাঁকে পাল্টা জানান, নিশিকান্তের সঙ্গে দু’টি সামাজিক অনুষ্ঠানে জয়কে দেখা গিয়েছিল। যার জবাবে জয় বলেন, অনুষ্ঠানে দেখা গেলেও তাঁর সঙ্গে নিশিকান্তের কোনও কথা হয়নি।
বিজেপি সাংসদ নিশিকান্তের অভিযোগ, শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করে সংসদে প্রশ্ন করার জন্য শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে ‘নগদ টাকা এবং দামি উপহার’ নিয়েছেন মহুয়া। এ নিয়ে তদন্তের দাবি তুলে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আরও অভিযোগ, সংসদেরর ওয়েবসাইটে লগ ইন করার জন্য নিজের কোড এবং পাসওয়ার্ড ব্যবসায়ী হীরানন্দানিকে দিয়ে দিয়েছেন মহুয়া। ওই ব্যবসায়ী দুবাইয়ে বসে তার ‘সুযোগ’ নিয়েছেন। মহুয়া অবশ্য পাল্টা দাবি করেন, সমস্ত সাংসদের লগ ইন কোড এবং পাসওয়ার্ড প্রকাশ করা হোক। তা হলেই বোঝা যাবে, আরও কেউ ওই একই কাজ করেন কি না।
লোকসভার স্পিকার নিশিকান্তের অভিযোগটি সংসদের এথিক্স কমিটিতে পাঠিয়েছিলেন। সেই কমিটি বৃহস্পতিবার ডেকে পাঠায় নিশিকান্তকে। ইতিমধ্যে হীরানন্দানি একটি হলফনামা দিয়েছেন। যাতে নিশিকান্তের অভিযোগের ‘বৈধতা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। যে হলফনামা প্রসঙ্গে মহুয়া পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘‘বয়ানটা প্রধানমন্ত্রীর দফতর লিখে দেয়নি তো?’’
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নিশিকান্ত এথিক্স কমিটিকে বলেন, তাঁর যা অভিযোগ, যা বক্তব্য, তার সবটা লোকসভার স্পিকারকে লেখা চিঠিতেই দেওয়া রয়েছে। তিনি তাঁর সেই অভিযোগগুলিই আরও এক বার কমিটিকে জানিয়েছেন বলে সূত্রের খবর। মহুয়ার ভূমিকায় দেশের নিরাপত্তা ‘বিঘ্নিত’ হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন নিশিকান্ত।
বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সরকারপক্ষের সঙ্গে সমানে-সমানে টক্কর দিয়েছে বিরোধীপক্ষ। যা মহুয়ার জন্য ‘আশাব্যঞ্জক’। আবার এ-ও ঠিক যে, চার জন সদস্য বৃহস্পতিবারের বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। ৩১ তারিখের বৈঠকে মহুয়া গেলে তাঁকে সরকারপক্ষের সদস্যেরা কী ভাবে চেপে ধরেন, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy