Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

ভোট এলে সবাই সবজান্তা!

পাড়ার দাদু, কাকু, জেঠুরা এমনিতে খুব শান্ত মানুষ। রাস্তায় দেখা হলেই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ভাল আছ তো মা?’’

মনীষা নস্কর
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০১:০২
Share: Save:

সন্ধ্যা ছ’টা বাজে। রীতিমতো আচমন করে ফোঁটা-তিলক কেটে, শুদ্ধ মনে পড়ার বই খুলে বসেছি। ভোটপর্ব চুকলেই যে পরীক্ষা! হাতে মোটে দু’টি হপ্তা। এইটুকু সময়ে রবীন্দ্রভারতীর বাংলা স্নাতকোত্তরের সিলেবাস শেষ করা আর এক ডুবে আটলান্টিক পেরোনো একই কথা। তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না। সবেমাত্র ‘যদুবংশ’টা খুলেছি। গণনাথের বাড়িতে চড়াও হয়েছে সূর্য, কৃপাময়, অভয়েরা। কী হয়, কী হয় ব্যাপার। তার মধ্যেই হঠাৎ বেজে উঠল, ‘হ্যালো-হ্যালো, মাইক টেস্টিং-মাইক টেস্টিং! ওয়ান-টু-থ্রি...’। ব্যাস‌্। ‘যদুবংশ’ মাথায় উঠল। গণনাথের দুঃখে ‘আহা’ বলব কী, নিজের বাড়িতেই যে চড়াও হয়েছে বিটকেল শব্দ-দৈত্য। জানলা দরজা বন্ধ করে দিলাম। লাভ হল না। মাইকের তেজ এমন যে জানলার কাচ ঠিনঠিন করে কেঁপে উঠছে! ইয়ারফোন গুঁজেও কাজ হল না। এমন প্রাণঘাতী নয়েজ় ‘ক্যানসেল’ করতে পারে, এমন শক্তিশালী ইয়ারফোন আবিষ্কার হয়নি। অগত্যা ‘যদুবংশ’ বন্ধ করে গালে হাত রেখে চুপচাপ শুনতে থাকলাম তেনাদের লেকচার।

পাড়ার দাদু, কাকু, জেঠুরা এমনিতে খুব শান্ত মানুষ। রাস্তায় দেখা হলেই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ভাল আছ তো মা?’’ শুধু প্রচারে বেরোলেই তাঁরা যে কোন ম্যাজিকে এমন ‘দাবাং টাইপ’ হয়ে ওঠেন, সে তাঁরাই জানেন! গলার শিরা ফুলিয়ে মাইক আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘অমুক আমাদের কী দিয়েছে? কিচ্ছু না। তমুক আমাদের কী দিয়েছে? কিচ্ছু না। আর আমরা আপনাদের সঅঅঅব দেব’’। পাড়ার সেই ‘কিউট’ দাদু, হাওয়া দিলেই যাঁর মাথার সাদা চুলগুলো ড্যান্ডেলিয়নের পাপড়ির মতো উড়তে থাকে, তিনিও আজ কেমন একটা হয়ে গিয়েছেন। ঘামে ফুরফুরে চুলগুলো চুপসে গিয়েছে। চোখ পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে, মুখে ফেনা তুলে কত্ত কী বকে চলেছেন। সেই জেঠুটি, দেখা হলেই যিনি সবাইকে টফি ধরিয়ে দেন, তিনিও স্টেজে দাঁড়িয়ে, ঘুসি পাকিয়ে রাগী চোখমুখে তেড়েফুঁড়ে ‘গরুর রচনা’ আউড়ে যাচ্ছেন।

ভোটের দয়ায় পরীক্ষা পিছিয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু মাইকের অত্যাচারে পড়াশোনা যে শিকেয় উঠেছে! সব দলেরই এক কথা, “আমরা ছাড়া বাকি সব্বাই খারাপ!” আদতে এখানে সবাই ‘চালুনি’। মিছিমিছি সবাই নিজের নিজের প্রিয় দলকে ‘সূচ’ বলে চালাতে চাইছেন।

ভোট এলেই চেনা মানুষগুলো রাতারাতি বদলে যান। সারা বছর কারও সাতে-পাঁচে না থাকা, গোবেচারা ভালমানুষটি ঝান্ডা কাঁধে প্রচারে বেরিয়ে পড়ছেন, স্টেজে উঠে গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন। সদ্য কলেজে ওঠা যে ছেলেটা ফেসবুক, পাবজি, গেম অব থ্রোনসের বাইরে অন্য কিছুর খবর অ্যাদ্দিন নেয়নি, সে-ও এখন ইউনিয়নের দাদাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে প্রচারে। সারা বছর মস্তানি করে আসা কাকুরা এখন হঠাৎই বড্ড বেশি মধুর সুরে কথা বলছেন। সে প্রসঙ্গেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র দীপ মাইতির টিপ্পনী, ‘‘ভোটের আগে সব দলের লোকজন বড় বেশি বিনয়ী হয়ে গিয়েছেন। যাঁদের সারা বছর দেখাই পাওয়া যায় না, তাঁরাও কোথাও থেকে উদয় হয়েছেন আবার!’’

বাসে-ট্রেনে-মুদির দোকানে, সর্বত্র এখন একটাই হট টপিক— ‘ভোট’। কথাবার্তা শুনে তো মনে হয়, সবাই একাধারে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ। দেশটা এঁদের হাতে পড়লে ‘চুটকিয়োঁ মে’ স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে। সবাই চলন্ত উইকিপিডিয়া। ইন্টারনেট ঝেড়ে দু’চারটে সরকারি পরিসংখ্যান, কিছু বাঘা বাঘা লোকের বক্তব্য জায়গা মতো বলে দিতে পারলেই হল! ভোটের বাজারে সব্বাই সবজান্তা। নীল লুঙ্গি পরা কাকু রোজ বিকেলে এসে বসেন পাড়ার মুদি দোকানে। শ্রাবন্তী কেন তিনটে বিয়ে করলেন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কেন মেট গালায় ‘ঝোপড়া’ সাজলেন, আইপিএলের টাকার খেলা— সমস্ত বিষয়েই তিনি নিজস্ব মত অকুতোভয়ে পেশ করেন এবং উপস্থিত জনতার প্রায় ঘেঁটি ধরে সমর্থন আদায় করে ছাড়েন। আজকাল তিনি এক কাপ চা আর আধপোড়া বিড়ি নিয়ে সরকারের বাজেটে কোথায় কী গলদ, সে গলদ কী ভাবে সংশোধিত হবে— সব কিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। ফেসবুকে একটু চোখ বোলালেই

এমন কাকু মিলবে ভূরি ভূরি। অফিসটাইমে বাসে উঠলেই দেখতে পাই, প্রায় সবার হাতে গুটিয়ে রাখা খবরের কাগজ। ঠকাস ঠকাস তা দিয়ে চাঁটি মেরে বলছেন, ‘‘মোদী তো দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। নেহাত বাংলায় দিদি আছেন, তাই...’’। অন্য এক জন তাঁকে থামিয়ে শুরু করেন, ‘‘দিদি? আর দিদি দেখিও না ভাইটি। দুটো সাইকেল দিয়ে আর চারটে মেয়ের বিয়ে দিয়েই যদি দেশ চালানো যেত, তা হলে তো হয়েই যেত! নীল-সাদা রং করলেই কী আর...!’’

রবীন্দ্রভারতীর বাংলা বিভাগের ছাত্র শঙ্খ দত্তের কথায়, “ভোটের মুখেই বোঝা যাচ্ছে সার্বিক ভাবে দেশে রাজনীতির মান কতখানি নেমে গিয়েছে। কোন ইস্যুগুলো সামনে রেখে দলগুলো ভোট চাইছে, তা থেকেই বোঝা যায় কোন দলকে এ সময়ে প্রয়োজন। যারা বেশির ভাগ মানুষের উপকার করতে পারবে, ভোট তো তাদেরই দেব।”

ভোটের সময়ে সবজান্তা হলেই কি ভোট পাওয়া যায়!

(রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy