পাচারের পথে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র। নিজস্ব চিত্র
টাকায় নাকি টাকা টানে।
‘‘হক কথাই তো। ওপারের টাকা এ পারে এসেই তো টাকা টানে। না হলে আয় হবে কী করে?’’ প্রশ্নটা শেষ করে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন শোভাপুরের মাঝবয়সি চাষি সোমশঙ্কর বিশ্বাস।
সে কেমন হিসেব! বাংলাদেশি টাকা নাকি? সোমশঙ্করবাবুই বুঝিয়ে দিলেন। ওপার থেকেই আসে টাকা। তবে তা বংলাদেশি নয়, এ দেশেরই টাকা তো। ওপার থেকে ছেপে আসে। আসলে সে জাল টাকা।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শোভাপুর বাংলাদেশ লাগোয়া গঞ্জ। মালদহের কালিয়াচক ৩ ব্লকের এলাকা। সেখান থেকে মাইলকয়েক এগোলে পারশিবপুর। তারপরে গঙ্গা। দেশের সীমানা সেখানেই শেষ। প্রান্তিক এই গ্রাম গত কয়েকবছর ধরে গোয়েন্দা পুলিশের নজরে রয়েছে। শুধু শোভাপুরই নয়, দৌলতপুর, জৈনপুর, ভগবানপুর, পার দেওয়ানপুর, পারশিবপুর, পার বৈদ্যনাথপুর, চাঁদপুর, ধরমপুরে পুলিশ ঢোকা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ সীমান্তের থেকে মালদহের সীমান্তের চরিত্র আলাদা। অন্য সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারের নানান রকমফের। মালদহের বৈষ্ণবনগর, হবিবপুর, কালিয়াচকের চরিত্র আলাদা। শোনা গিয়েছিল, টাকা জাল করা নাকি এখানকার কুটির শিল্প।
সে প্রশ্ন শুনে এক চোট হাসেন, পারশিবপুরের বাসিন্দা সুলেমান শেখ। তিনি বলেন, ‘‘না, বিষয়টা তেমন নয়। টাকা এখানে ছাপা হয় না। আর গ্রামের সব বাসিন্দাই তো পাচারকারী নন। তবে ওপার থেকে এ পারে নিয়মিত জাল টাকা আসে। সেগুলি বিভিন্ন পথ ঘুরে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য এবং ভিন্ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।’’
তিনিই জানালেন, ও পার থেকে যেমন এ পারে জাল নোট আসছে, তেমন এ পার থেকে ওপারে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। যার ডাক নাম ‘গান’। তার ফলে বদলাচ্ছে এলাকার অর্থনীতি। মূলত কৃষি নির্ভর এলাকা। কৃষিতে নাকি ধারাবাহিক লোকসান। তার পরেও গ্রামে গ্রামে পাকাবাড়ি বাড়ছে। বাড়ছে চারচাকা গাড়ি, মোটরবাইক। গ্রামের চা দোকান, নদীঘেঁষা মাচা, কোথাও সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
ভোটের সময়ে রাজ্যের অন্যান্য সীমান্তে বেজায় কড়াকড়ি। তার পরেও মালদহে জাল টাকা ঢুকছে কী করে? রাজ্য তথা দেশে জাল টাকা ছড়ানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে রাজ্যের অন্যান্য সীমান্তে তা হয় না কেন? সে প্রশ্নের উত্তর মিলল মুর্শিদাবাদের এক পুলিশ কর্তার কাছ থেকে। তাঁর কথায় ভৌগোলিক সুবিধাই তার প্রধান কারণ।
তিনি জানালেন, মুর্শিদাবাদের ফরাক্কাকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করে পাচারকারীরা। কয়েকটি রুট ব্যবহার করে পাচারকারীরা। শোভাপুর-দৌলতপুর-পারলালপুর ফেরিঘাট হয়ে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান শহরে। আবার জৈনপুর-ভগবানপুরের বাঁধের রাস্তা ধরে ফরাক্কা-চামাগ্রাম রেলস্টেশন। ফরাক্কার এনটিপিসি মোড় থেকে সহজেই কয়েক মাইল পার হতে পারলেই ঝাড়খণ্ডের পাকুড়। ফরাক্কা থেকে সড়ক এবং রেল পথে জাল টাকা ছড়াচ্ছে দক্ষিণ এবং উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। আবার মুঙ্গের এবং কলকাতা শহরতলি থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের বিভিন্ন অংশ পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ লাগোয়া গ্রামগুলিতে। সেখানে যন্ত্রাংশ জুড়ে তৈরি ওয়ান শটার, নাইন এমএম রিভলভার চলে যাচ্ছে ও পারে।
এক সময়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দোকানে দোকানে জিনিসপত্র সরবরাহ করতেন শাহিল মল্লিক (নাম পরিবর্তিত)। এখন তিনি একজন ‘ক্যারিয়ার’। মূলত ফরাক্কাতেই থাকেন তিনি। জানালেন, ফিনিশিং ভাল হলে এক লক্ষ জাল টাকার জন্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। ফিনিশিং খারাপ হলে ২০-২২ হাজার। একটি ওয়ান শটার ৫-৭ হাজারে বিকোয়। আর নাইন এমএমের ফিনিশিং ভাল হলে ২৫-৩০, এমনকি ৫০ হাজার টাকাও মেলে। তবে পুলিশ তাজ্জব অন্ধ্রপ্রদেশের দুই যুবককে পাকড়াও করে। তাদের কাছ থেকে মিলেছিল দু’লক্ষ টাকার জাল নোট। পরে জানা যায়, ওই দু’জন অন্ধ্রপ্রদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড। পুলিশ নিশ্চিত, জাল নোট দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়াচ্ছে।
পদে পদে ঝুঁকি। বিএসএফ-এর গুলি, পুলিশের গ্রেফতারির ভয়, তার পরেও কেন পাচার? শাহিলের উত্তর, আসলে শর্টকাটে রোজগার পথ বদলাতে দিচ্ছে না ওদের। তার ফলে ঝুঁকি আছে জেনেও পাচার বাড়ছে। পুলিশ গ্রেফতার করছে, ছাড়া পেয়ে ফের সেই একই কারবারেই ফিরছে তারা।
শুধু শাহিল নয়, সীমানা ঘেঁষা গাঁ-গঞ্জে কথা বলে হাজারো সওয়ালের পরে বোঝা গেল, সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy