সাপ লুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে।
ভোটের মুখে এক কথায় এটাই দমদমের দেওয়াল লিখন।
ভাগ্য কাকে কখন সাপের মুখে ফেলবে, আর পুট ফেলেও কে উঠে যাবে সিঁড়ির মাথায়, তা নিয়ে বিস্তর ঝাঁজ আর রসিকতা সহাবস্থান করছে ও দিকে পেনেটির গঙ্গার ঘাট থেকে এ দিকে একদা লর্ড ক্লাইভের দমদম পর্যন্ত। দমদম লোকসভায় দৃশ্যত উত্তেজনা নেই। তবে টেনশন আছে। মানুষ অঙ্ক কষছেন। রাজনীতিকেরাও।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বছর কয়েক আগে ভূমিকম্পে যখন তছনছ হল নেপাল, কলকাতাও নড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ দমদমের কলোনি অঞ্চলে সিপিএমের প্রাক্তন এলসিএম (লোকাল কমিটি মেম্বার) ছুটে ছুটে পাড়ার লোকেদের রাস্তায় নামিয়ে আনছিলেন। আশঙ্কা ছিল, গায়ে গায়ে ঠাসা বাড়ির একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাশেরটাও হবে।
টোকা লাগলে ভোট বাক্সেও যে ভূমিকম্প হয়, দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাও নিমেষে সাপের মুখ বেয়ে নেমে যান সকলের নীচে, দমদম তা বিলক্ষণ জানে। ১৯৯৮, ’৯৯ সালে বাম দুর্গে গেরিলা কায়দায় গেরুয়া আক্রমণ করেছিলেন বিজেপি প্রার্থী তপন শিকদার। কমরেডদের ভাগ্যে ধস নামিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছিলেন। আবার ভাগ্যের পরিহাসে পরবর্তীকালে বিজেপি ধসে গিয়েছে ২০ শতাংশের নীচে।
‘‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না তো?’’ পরিবর্তন জমানায় প্রাক্তন হয়ে যাওয়া সেই বামপন্থী এবং তাঁর ঘাস-ফুল বন্ধুরা পাড়ার রকে সেই আলোচনাতেই মশগুল।
কেন্দ্র এক নজরে - দমদম
• মোট ভোটার: ১৫,৫৬,৭২৫
• ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সৌগত রায় জয়ী হন। জয়ের ব্যবধান ছিল ১,৫৪,৯৩৪
• ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে এগিয়ে তৃণমূল। মোট ৭টি বিধানসভার মধ্যে ২টিতে জয়ী বাম-কংগ্রেস জোট। ৫টিতে তৃণমূল।
তাঁদেরই এক জনের বক্তব্য, ‘‘পাটিগণিত, অ্যালজেব্রা, কোনও অঙ্কেই বিজেপির নম্বর নেই এ তল্লাটে। ২০১৪ ছেড়ে দিন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও দমদম লোকসভা কেন্দ্রের ৭টি বিধানসভায় তাদের গড় ভোট সাকুল্যে ১০ শতাংশ। তবু বাতাসে পদ্ম-হাওয়া ঘুরছে।’’
‘ললাট লিখনে’ বিশ্বাস নেই দাবি করে ‘দেওয়াল লিখনে’ মন দিতে বললেন প্রবীণ তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়। এলাকা ভেদে উনিশ-বিশ তফাত থাকলেও, লোকসভা কেন্দ্রের ৭০% দেওয়ালেই রং-বেরঙে তাঁর নাম।
স্বাভাবিক! ২০০৯ থেকে ক্ষমতার রাশ তো তাঁরই হাতে। প্রবীণ তৃণমূল প্রার্থী এলাকায় দু’বারের সাংসদ। যদিও লোকে বলছেন, সেটা যেমন তাঁর সুবিধার জায়গা, আবার অসুবিধার কারণও বটে। সৌগতবাবুর হাত ধরে তৃণমূল ‘পরিবর্তনে’র দমদমে থাবা বসালেও, ক্ষমতার তেজ এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার দলীয় রাজনীতি। ফলে দলের ভিতরেই দল-বিরোধী চোরাস্রোত কাজ করছে। এ হেন পরিস্থিতিতে অতীতে সাপলুডোর দানে একের পর এক ছক্কা হাঁকানো সৌগতবাবু সিঁড়ি আর সাপ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
অঙ্ক বলছে, ২০০৯-এ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-পর্বে হাজার বিশেক ভোটে অমিতাভ নন্দীর দমদম দখল করেন সৌগতবাবু। তখনও বামেরা বিশ্বাস করতে পারেননি, দু’বছরের মধ্যে লোকসভার সাতটি বিধানসভাতেই বিপুল ঝাঁকুনি অপেক্ষা করছে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান আরও বেড়ে হল দেড় লক্ষের কিছু বেশি। এটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়। আর তার ঠিক ২ বছরের মাথায় ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাপের মুখে পড়ে দমদম লোকসভার সাতটি বিধানসভার ২টি হাত ছাড়া হয় তৃণমূলের। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উত্তর দমদম আর মদন মিত্রের কামারহাটি। খড়দহ এবং পানিহাটি বাদ দিলে বাকি তিনটি বিধানসভাতেই জয়ের ব্যবধান ১০ হাজারের নীচে। পুরো লোকসভার ফল যোগ করলে বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে তৃণমূলের ভোট ব্যবধান ৪৫ হাজারের আশপাশে। অর্থাৎ, ১ লক্ষেরও বেশি ক্ষয়।
অধ্যাপক সৌগতবাবু বিলক্ষণ জানেন এই হিসেব। মানেন কোনও কোনও অঞ্চলে ‘দুর্বলতা’র কথা। বিজেপি হাওয়াও অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, প্রার্থী হিসেবে এলাকায় এখনও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে। ফলে নিজের ‘ক্যারিশমা’তেই ভরা কোটালেও বৈতরণী পার হতে পারবেন। দমদম বিধানসভার বিধায়ক ব্রাত্য বসুও একই কথা মনে করেন। ‘‘দমদমে তৃণমূলকে হারানোর মতো শক্তি এখনও কারও তৈরি হয়নি।’’
অঙ্ক নেই। তাই হিসেবেও আগ্রহ নেই পোড় খাওয়া রাজনীতিক শমীক ভট্টাচার্যের। তিনি যা বলছেন, রাজ্যের ৪২টা কেন্দ্রে প্রত্যেক বিজেপি প্রার্থীই সে কথা বলছেন। ভূমিকম্পের যে পূর্বাভাস তৈরি হয়েছে, তার কম্পাঙ্ক এতটাই বেশি, যে সেখানে অঙ্কের হিসেব কাজ করে না। একদা তপনবাবুর সময় যা হয়েছিল। যদিও শমীকবাবু জানেন, তপনবাবু যখন জিতেছিলেন, দমদম কেন্দ্রে তখনও পুনর্বিন্যাস হয়নি। পূর্ব বেলগাছিয়া বিধানসভা ছিল এই কেন্দ্রের অন্তর্গত। বিজেপির বরাবরই সেখানে একটা ভোট আছে। আর তপনবাবুর জেতার পিছনে সুভাষ চক্রবর্তীরও যে হাত ছিল, সে কথা রাজনৈতিক মহলে এখন কার্যত ‘ধ্রুব সত্য’। শমীক জানেন, খেলা যদি ঘোরাতে হয়, তা হলে এ বারেও বাম সমর্থন প্রয়োজন।
কী ভাবে? শমীক সম্ভবত বিজেপিরএকমাত্র প্রার্থী যিনি মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রচার অভিযান শুরু করেননি। বন্ধ জেসপের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম সভা করেন বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের কায়দায়। সরাসরি এলাকার বামপন্থী মানুষের কাছে ভোট দেওয়ার অনুরোধও জানান। লোকে বলছেন, এটাই শমীকের সুবিধার জায়গা। আবার অসুবিধারও।
‘বাম ভোট রামে যাচ্ছে’, রাজ্যে এটা এখন চলতি কথা। উত্তর দেবেন ‘ইভিএমেশ্বর’। আর অসুবিধা, বিজেপির কট্টরপন্থী কর্মী সমর্থকদের একাংশ আড়ালে প্রার্থীর ‘বামপনা’য় ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করছেন। এতে মেরুকরণের ভোট হাত ছাড়া হতে পারে বলেই তাঁদের ধারণা।
রাজ্যে মেরুকরণের হাওয়া আছে, মানেন দমদমের বামপ্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য। তবে দমদমকে তার মধ্যে ফেলতে চান না তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘শহুরে দমদমে ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষিত ভোটার। পুরুষের চেয়ে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি। মোদী-মমতার গালাগালির রাজনীতি তাঁরা নিয়মিত টেলিভিশনে দেখছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুনছেন।’’ শহুরে ভোটার তাই বিকল্প হিসেবে ফের বামপন্থায় ফিরতে চান বলেই তাঁর বিশ্বাস।
হাতে লেখা একটি কাগজে ২০১৬ সালে দমদমের সাতটি বিধানসভার ফলাফলের অঙ্ক লিখে এলাকায় হোয়াটসঅ্যাপে ঘোরাচ্ছে সিপিএম। দেওয়ালে নয়, নতুন প্রজন্মের কাছে বামেদের দেওয়াল লিখন এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্থানীয় যুবকদের কেউ কেউ বলছেন, এটা সুবিধার দিক। কিন্তু অসুবিধা হল, যে শিক্ষিত তরুণ ভোটারদের কাছে পেতে চাইছে বামেরা, সমীক্ষা বলছে, কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজ করা সেই মধ্যবিত্তের বড় অংশ এখন বাম-বিরোধী। আর তপন শিকদারকেও তো বামপন্থীরাই ভোট দিয়েছিলেন। সে জুজুও ওড়াতে পারছেন না এলাকার বামপন্থীরা।
পুনশ্চ: দমদমে কংগ্রেস প্রার্থী রাজনীতিতে নবাগত সৌরভ সাহা। বেশ কিছু মিটিং-মিছিল করলেও, অধুনা তিনি হাসপাতালে।
দমদমের ‘শিক্ষিত’ ভোটারদের অনেকরই মত, সাপ লুডোয় কার কপালে কী ঝুলছে, তা খানিকটা নির্ভর করছে কংগ্রেসের ভোট অন্য দলে যাবে কি না, অথবা কংগ্রেস অন্যের ভোট পাবে কি না, তার উপরেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy