বাড়ি নশিপুর। থানা লালগোলা। লোকমুখে তিনি হুজুবুড়ি। তাঁর নাম মাহাত্ম্যের বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনি আছে। তিনি অবশ্য এখন বেঁচে নেই। কিন্তু সেই ভোট-আমলে তাঁর সরকারি নাম ছিল হজিরন বেওয়া। ছেলের নাম হজরত শেখ। লোকমুখে বিবর্তিত হয়ে কালক্রমে হজরতের মা হজিরন বেওয়া হয়ে যান হুজুবুড়ি। হামেশাই অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটিয়ে পড়শিদের মুখরোচক আলোচনার বিষয় হয়ে পড়তেন সেই হুজুবুড়ি। তাঁকে নিয়ে বিস্তর হাসিঠাট্টা চলত। তিনি গত হলেও ভরা ভোটবাজারের হরেক আলোচনায় উঠে আসে তাঁর নানা কাণ্ড।
১৯৯৮ সাল। পেশায় রাজমিস্ত্রি স্বামী মারা গিয়েছেন। হুজুবড়ি তখন পঁয়ষট্টি ছুঁইছুঁই। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটের জোর প্রচার চলছে। তিনি তাঁর জীবনে প্রথম বার ভোটকেন্দ্র গিয়ে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার না ফেলে, আঁচলে বেঁধে বাড়ি ফেরার উপক্রম করেছিলেন। কিন্তু বুথের ভিতরেই ধরা পড়ে ভোটকর্মীদের দ্বারা সে বার কিঞ্চিৎ ‘অসম্মানিত’ হয়েছিলেন। সেই ক্ষত মধ্য ষাটেও নিরাময় হয়নি। ফলে জীবনে আর কোনও দিন তিনি বুথমুখো হবেন না বলে ‘খোদার কসম’ খেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তাঁর সেই পণে চিড় ধরে প্রয়াত মন্ত্রী আব্দুস সাত্তারের ছেলে তথা কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়ক আবু হেনার কারণে।
সিপিএম ও কংগ্রেস থেকে শুরু করে সব দলের কর্মী থেকে প্রার্থী সকলেই পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। এ দিকে গাঁ জুড়ে হুজুবুড়িকে নিয়ে একটি প্রচার বেশ জবরদস্ত রকমের প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে। যে দলের লোকই ভোটপ্রচারে আসুক না কেন, তাঁদের সঙ্গে হুজুবুড়ির পড়শিরা বাজি ধরতেন। পড়শিরা বলতেন, ‘‘হুজুবুড়ি কোনও বার ভোট দিতে যায় না। কোনও দিন যাবেও না বলে কসম খেয়েছে। তাঁকে ভোট দেওয়াতে পারলে দিশি মোরগের ঝোল দিয়ে পেটপুরে ভাত। বাজি থাকল।’’ ফলে সব দলের কর্মীরাই তাঁর কাছে গিয়ে ‘খালা’, ‘ফুফু’, ‘চাচি’, ‘নানি’ বলে হাত কচলিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার আবদার করতেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
হুজুবুড়ির কাছে গিয়ে সব দলের কর্মীদের একটাই বুলি ছিল, ‘‘তুমি যাকে খুশি ভোট দাও, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। ভোট তো গোপনে দেবে। কাকে দেবে কেউ জানতে পারবে না। তাই তোমাকে কিন্তু এ বার ভোট দিতেই হবে।’’
তবুও চিঁড়ে ভেজেনি। অবশেষে ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েতের ভোট প্রচারে গিয়ে বিধায়ক আবু হেনা হুজুবুড়ির হাত ধরে অনুরোধ করেন, ‘‘চাচি! এ বার কিন্তু তুমি ভোটটা দিতে যেও। আর ভোটটা কিন্তু হাতেই দেবে।’’ হুজুবুড়ি এ বার বেকায়দায় পড়েন। পড়শিদের বলেন, ‘‘সাত্তার মন্ত্রীর ব্যাটা বলে কথা। তাই আবার হেনা হাইকোর্টের উকিল! কী যে করি!’’
এ দিকে তিনি ‘কসম’ খেয়েছেন। ফলে মনে তাঁর ঘুরপাক খাচ্ছে দুশ্চিন্তা, ‘‘আল্লার কসম ভাঙলে খোদা দুঃখ পাবে। আবার হেনার কথা না রাখলে মন্ত্রী সাত্তারের রুহু (আত্মা) শান্তি পাবে না!’’
অবশেষে হাইকোর্টের উকিলই জেতেন। নানা ধানায়-পানায় করে হুজুবুড়ি অবশেষে ভোট দিলেন। তার পরে বুথ থেকে বের হতেই সব দলের ছেলে ছোকরারা তাঁকে ঘিরে ধরে। জানতে চাইলেন, কাকে তিনি ভোট দিয়েছেন। অনেক পীড়াপীড়ির পরে মুঠোবন্দি হাত খুলে মেলে ধরে হুজুবুড়ি বলেন, ‘‘আমি তোদের মতো ইমান নষ্ট করিনি। হেনা বলেছিল হাতে ভোট দিতে। এই দেখ, হাতের তালুতেই ভোটের ছাপ!’’
দেখা গেল, তাঁর তালুতে ভোটের তিনটি সিলের ভেজা ছাপ। আর ব্যালট পেপার যথারীতি তাঁর আঁচলেই বাঁধা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy