Advertisement
E-Paper

মজে যায়, তবু কপোতাক্ষ যে মোছে না

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ

ডিঙি নিয়ে কৃষ্ণ ছইয়াল।

ডিঙি নিয়ে কৃষ্ণ ছইয়াল। নিজস্ব চিত্র।

রবিশঙ্কর দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ ০৭:২০
Share
Save

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ

নাম কৃষ্ণ। আর পদবি ছইয়াল।

তার পরেও সুরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই! কেমন মাঝি আপনি, গান জানেন না? শখ করে কেনা একটা বাঁশি অন্তত?

সামনে দাঁড়িয়ে সে কথা স্বীকার করতে কপট সঙ্কোচ ভদ্রলোকের মুখে। পিছনে জলের মধ্যে দুলতে থাকা ডিঙিখানার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন।

কচুরিপানায় আটকে যাওয়া ওই ছোট্ট নৌকা এগিয়ে নিতে প্রতিযাত্রায় প্রাণপাত করতে হয় তাঁকে। যাত্রীদের হাতে বৈঠা আর লাঠি ধরিয়ে দিয়ে তাঁদের পানা সরিয়ে পথ করতে বলেন। তারপর সেই পথে জল কাটতে কাটতে এগিয়ে যান তিনি। এই যাত্রা কেমন যেন তাঁর নিজের জীবনের প্রতীক হয়ে এগিয়েছে।

সুরে ভাসার সময় কোথায় তাঁর? সে সব যে তাঁর মন টানে না, তা নয়। ঘাট ফাঁকা কি না দেখে নিয়ে গলার তুলসীমালায় হাত রেখে কৃষ্ণ বললেন, ‘‘আমরা কৃষ্ণভক্ত। সে সব গান শুনি ঠিকই, গাইতে পারি না।’’ ভরদুপুরে কলোনির মেয়েবউদের কীর্তন শুনতে ও পাড়ে পৌঁছে দিয়ে খোঁজও নেন, ‘‘ফেরবা কখন?’’

বাঁওড় পেরিয়ে নৌকায় ভরতপুরের লোকেদের গাঁড়াপোতায় নিয়ে আসেন। আবার তাঁদের ফেরার অপেক্ষা করেন। মাথাপিছু ২ টাকা পারানি। পূর্ণিমা হোক বা অমাবস্যা, রাতেও তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় এই জলে। শেষে খালি নৌকা টেনে নিয়ে যেতে হয় কোনও কোনও দিন। তাই গান আসেনি তাঁর গলায়। তবে ঘাটে বসে তাঁর কথা হয় ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলতে থাকা রাজহাঁসের দলের সঙ্গে। অনেক কথা। কাঁধের কাছে উড়ে বেড়ানো ফড়িং আর বকের সঙ্গেও।

উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ থেকে যে রাস্তাটা সোজা বাংলাদেশ সীমান্ত বয়রা আর দত্তফুলিয়া গিয়েছে, তার একধারে এই বাঁওড়েই জীবন আর জীবিকা কৃষ্ণের। পাশের স্কুলের ঘণ্টা গুনে এক-একটা দিন এগিয়ে চলেন তিনি।

ছইয়ালের জমি-জিরেত নেই। তবে তাঁদের ভরতপুরে চাষবাস ভালই। সর্ষে সব উঠে গিয়েছে। ঘাট থেকেই এখন চার পাশে ধানসিদ্ধ আর গোবর শুকোনোর গন্ধ। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মাঠ ছেড়ে এগোলে ধান, সর্ষে আর ধনের খেত। নিজের জমি- জিরেত তেমন কিছু না থাকলেও ধানিপানি গ্রামের গতিতে নিজেকে জুড়ে দিয়ে সংসার চালিয়ে নিয়েছেন কৃষ্ণের মতো অনেকেই। পান-সুপুরির গন্ধ ছড়িয়ে বলতে পারেন, ‘‘ছেলে দুটো বড় হয়ে গেছে। আমার জীবন তো কেটেই গেল।’’

এই যে রাস্তার পাশে নিজের বাঁশবন সাফ করে এখন দোতলা বাড়ি করেছেন বিশ্বনাথ বিশ্বাস। তাঁর যৌবন কেটেছে নিজের চাষের জমিতে। দু’পাশে এই রকমই অসংখ্য লড়াই দেখেছেন নব্বুই ছুঁইছুঁই ভদ্রলোক। এখন দোতলার বারান্দায় পেরিয়ে আসা সেই ‘আলপথ’ ভেবে হাসেন, আঙুল দিয়ে বাইরের দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘‘এ সব তো জঙ্গল ছিল। দোকানপাট, বাজার, মন্দির, স্কুল সব ধীরে ধীরে হয়েছে।’’

এই রকম ধীরে ধীরেই এগোতে হয় বোধহয়। দু’একটা জায়গায় ছন্দপতন আছে ঠিকই, তবে ঠিক তেমনই ধীরে এগোচ্ছে এখানকার গ্রামজীবন।

দত্তফুলিয়ার রাস্তা গিয়েছে নদিয়ায়। আর অন্যটা হেলেঞ্চা, বাগদা হয়ে একেবারে বাংলাদেশ সীমান্ত। ভালমন্দ মেশানো রাস্তায় হা হা করে ছুটছে বড় বড় বাস। অটোরিকশা, মোটরবাইক। সে রাস্তা জুড়ে শুধু ধনেপাতার গন্ধ। সবুজ গাছের মাথায় সাদা ফুলের রাশি দেখে মনে হয়, বরফ পড়েছে।

এই পথেই হেলেঞ্চা বাজারের আগে নোনচেপতা। মোড়ের মুখে বিশ্বাসদের মিষ্টির দোকান। তার গা ঘেঁষে রাস্তা ঢুকেছে ঝিকরার দিকে। গ্রামের ভিতরে ঢালাই রাস্তা আছে তবে তা খানিকটা। রাস্তার দু’দিকে ছোটবড় চাষিবাড়ি, চাষের জমি, পুকুর, মন্দির, মুকুলভরা আমগাছ, ট্র্যাক্টর, ধানের ঘর। তারই একটার উঠোনে বসে হামানদিস্তায় ন্যাপথালিন গুঁড়ো করছিলেন পাঁচু বিশ্বাস। ফুলহাতা শার্ট আর লুঙ্গিতে নির্মেদ চেহারা। ঠোঁটের কোণের বিড়ি দাঁতে চেপে বললেন, ‘‘এ সবাই জানে না। পটলের খেতে ছড়িয়ে দিলে গাছের রক্তরস ফসলে যায়। গোড়া খেতে পারে না।’’ হাতে একটা হাসুয়া নিয়ে নিজের জগতে মিলিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বাগদার পটল আর বেগুন তো বিখ্যাত।

বিরাট জলার উল্টো দিকে বটগাছের তলায় ইদগা। সামনে তাঁর কলাবাগান। সিঙ্গাপুরি, চাঁপা, মর্তমান আর কাঁচাকলার খেত তাঁর। তার মধ্যে কোথাও গাজর, কোথাও শিম আর ছড়িয়ে পটল। হাঁটেন না, নিজেদের চাষের জমিতে যেন ভেসে বেড়ান পাঁচু, তাঁর ছেলে বিদ্যুৎ। খেজুর গাছে ঝুলিয়ে রাখা মাটির হাঁড়ির দিকে হেঁসো উঁচিয়ে বলেন, ‘‘এই যে রস, এ এখন অমৃত।’’ ‘কৃষকবন্ধু’র ভাতা পেয়েছেন, ১০০ দিনের কাজের সুবিধা পেয়েছেন। ধীরে ধীরেই এগিয়ে মাটির বাড়ি পাকা করেছেন। উঠোনের কোনায় লক্ষ্মীর কৌটোর আকারের বেত- বাঁশের তৈরি ছোট গোলা দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘এখন ওই কান পর্যন্ত, মণ ৩০ আছে।’’ নাতিকে ঠাকুরদাদা বলে ডাকতে শিখিয়েছেন। তাই তো এখানে চলন্ত বাসে হাঁক পাড়তে শোনা যায়— বেয়াই, কবে এলেন গো?

বিনয়ী গ্রামে সচ্ছলতার চিহ্ন অবশ্য প্রায় প্রতি বাঁকেই। বিরাট বিরাট তোরণ পড়েছে। এ পাড়ায় ও পাড়ায় নামযজ্ঞের আসর চলছে, চলবে গোটা ফাল্গুন। তাতে চৈতন্যদেবের দু’হাত তোলা ছবি। বাজারে চায়ে মুখ ভিজিয়ে প্রবীণ বলেছিলেন—কেউ কেউ তো ঘোষণা দিয়েছেন, ষোলো প্রহরের আয়োজন।

পিচরাস্তায় ফিরে বাজার ছাড়ালে রাস্তা সীমান্তের দিকে। রামনগর- দরগাতলা। কুড়ুলিয়া, মেহেরানী। সার দেওয়া লম্বুগাছের মধ্যে টিনের ছ’চালা। এক পাশে ছাগলজোড়া বাঁধা। সাফসুতোর উঠোনে বুড়ো আঙুল আর প্রথমায় ছাই টিপে বজুরি ট্যাংরার মাথা ধরে কাঁটা ফেলে পেট পরিষ্কার করছিলেন তরুণী বধূ। পাশ দিয়ে শব্দ করে ছুটে যাওয়া বাসের দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন। এই পথই পৌঁছেছে বয়রা বাজারের কাছারি বাড়িতে। । জমিদারের নায়েব বসতেন। বিশাল চেহারার প্রহরী থাকত দরজায়। নোনা ধরে খসতে থাকা ইটের সেই ইতিহাস মোড়ের চায়ের দোকানে এখনও তাজা।

পরপর আনাজ আর মাছের পসরা, কুল গাছ, গাই-বাছুর, পাড়ার আড্ডা পাশ কাটিয়ে সামনে লক্ষ্মীপুরের সবুজ আর সবুজ। চাষির মুখে প্রশান্তি, বলেন, ‘‘ভরে দেয় গো জমি। এ পার ও পার খামতি নেই।’’ তারকাঁটার ও পারেও ভারতীয় জমি। চাষবাস, বসত। তার আগে সীমান্তরক্ষীদের আস্তানা। সেখানে পরিচয়পত্র রেখেই যাতায়াত।

এই জমির এক টুকরো ছুঁয়ে ফের বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছে কপোতাক্ষ। চোখের সামনে তার বেশ খানিকটা নড়াচড়া করে। জল পড়ে অনেক নীচে। পানা ভাসে, বক বসে। জলের বৃত্ত গড়িয়ে যায় হালকা তরঙ্গে। নাড়া লাগে ইতিহাসে।

সব শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল এই পথে। বৈভবের মধ্যে অস্পষ্ট বিষাদ স্পর্শ?

কানে এল ভারী গলা— ছবি তোলা যাবে না। ফোনে তোলা সব ছবিই মুছে দিন।

প্রত্যুত্তরে হাসি ছাড়া কী বা থাকে?

কাকে বোঝাই, মজে গেলেও, বুজে এলেও কপোতাক্ষ যে কিছুতেই মোছে না।

মনে পড়ল কৃষ্ণ ছইয়ালের হাসিমুখ।

কত কিছু করা হয় না।

bongaon North 24 Parganas Gram Darshan

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}