কান্নায় ভেঙে পড়েছেন রাজীবের মা সাধনা ভট্টাচার্য। শুক্রবার বরাহনগরের বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
পরিবারের সবাই খবরটা জানতেন। জানতেন না শুধু পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা মা। কিন্তু সকালের পুজো সেরে ঘরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল টিভিতে। ‘ব্রেকিং নিউজে’ দেখলেন পর্বতারোহী একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর!
তার পর থেকেই বাড়িতে ভিড় করা আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছে বৃদ্ধার প্রশ্ন— ‘‘যা দেখাচ্ছে তা সত্যি?’’
মায়ের কাছে ছেলের মৃত্যুর খবর লুকোতে আড়ালে চোখ মুছছেন আত্মীয়-বন্ধুরা। নেপালের ধৌলাগিরি শৃঙ্গ ছুঁয়ে নেমে আসার পথে মৃত্যু হয়েছে বরাহনগরের বাসিন্দা, ৪৩ বছর বয়সি পর্বতারোহী রাজীব ভট্টাচার্যের। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর বাড়িতে খবর এসে পৌঁছয়।
খবরটা শোনার পর থেকেই রাজীবের বাড়িতে রয়েছেন জেঠতুতো দাদা প্রবীর ভট্টাচার্য। তিনি জানান, ২০১৪-র শেষ দিকে তাঁর কাকা অর্থাৎ রাজীবের বাবা ভোলানাথ ভট্টাচার্য মারা যান। তার পর থেকে সাধনাদেবীর একমাত্র ভরসা রাজীবই। আর উপার্জন বলতে দক্ষিণেশ্বরে বাবার রেখে যাওয়া স্টেশনারি দোকান। সঙ্গে কিছু টিউশানি। প্রবীরবাবু বলেন, ‘‘কাকা মারা যাওয়ার পরে এক বছর বড় কোনও অভিযানে যায়নি রাজীব। তবে মাস দুয়েক আগে এই ধৌলাগিরি অভিযানের পরিকল্পনা করে ফের বেরিয়ে পড়েছিল।’’ ১৭ এপ্রিল আরোহণ শুরুর আগে শেষ ফোন করেন মাকে। বলেন ‘‘চিন্তা কোরো না। আবার জয় করেই ফিরব।’’
আর তাই এ দিন দুপুরে কিছুতেই ছেলের ‘পরাজয়ের’ কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সাধনাদেবী। প্রশ্ন করছিলেন, ‘‘ও তো সামিট করে ফেলেছিল। তার পরে কি কেউ অসুস্থ হয়?’’ আত্মীয়রা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, নামার সময় অক্সিজেন ছিল না। তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতেও থামেনি বৃদ্ধা মায়ের চোখের জল। আর পাঁচ পর্বতারোহী ছেলের মায়ের মতোই তাঁরও যে খানিক ধারণা রয়েছে পাহাড়ে চড়ার। তাই সাধনাদেবী ফের জানতে চেয়েছেন ‘‘অক্সিজেন না থাকলে যাবে কেন?’’
রাজীবের পরিবার সূত্রের খবর, ১৯৯০-এ বরাহনগর বিদ্যামন্দির থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পরই পাহাড়ে চড়ার নেশা চাপে রাজীবের। মামাতো দাদা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এবং কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে শুরু হয় পাহাড়ে চড়া। বিএসসি পাশ একমাত্র ছেলেকে বারণ করতেন বাবা-মা। বারবার আপত্তি নাকচ করে রাজীব বেরিয়ে পড়তেন শৃঙ্গের নেশায়।
শ্রীরামপুর ও উত্তরপাড়ার পর্বতারোহী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ‘অঙ্গন ছাড়িয়ে’ ক্লাবের সম্পাদক অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, শুধু পর্বতারোহী নয়, মানুষ হিসেবে এক জন দৃষ্টান্ত ছিলেন রাজীব। চিরকাল প্রচারবিমুখ রাজীব পর্বতারোহণের বিপুল খরচা সামলেও দীর্ঘদিন ধরে সাহায্য করতেন কাঁথির কাছে পাঁউসিতে অবস্থিত ‘অন্তোর্দয়’ অনাথ আশ্রমে। খবর পেয়ে শোকের ছায়া নেমেছে সেখানেও।
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো শিবের ছবিতে তখন ঝুলছে শুকনো মালা। নেপালে যাওয়ার দিন ওই ছবিতে মালা পরিয়ে বেরিয়ে ছিলেন রাজীব। ইচ্ছা ছিল শৃঙ্গ ছুঁয়ে এসে তা বদলাবেন ফের। কিন্তু তা আর হল না।
যদিও সারা দিন চোখের জলে, সাধনাদেবী ডেকেছেন, ‘‘ফিরে আয় বাবা। এক বার মা বলে ডাক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy