Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

কুয়ো থেকে দেহ উঠল ৩০ ঘণ্টা পরে

দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা সিভিল ডিফেন্সের মতো প্রশিক্ষিত বাহিনীকে হারিয়ে এ বারও জয় হল সেই কুয়ো শ্রমিকদেরই। সোমবার ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সাড়ে আটটা। চার ঘণ্টা মাটির নীচে থাকার পরে দড়ি ধরে উপরে এলেন ৫৯ বছরের নিতাইচন্দ্র পাল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তোলা হল ৪০ ফুট নীচে আটকে থাকা কুয়ো শ্রমিক অমর পালের দেহ।

সোমবার রাতে দেহ উদ্ধারের পরে। ছবি: শৌভিক দে।

সোমবার রাতে দেহ উদ্ধারের পরে। ছবি: শৌভিক দে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৪ ০১:৪০
Share: Save:

দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা সিভিল ডিফেন্সের মতো প্রশিক্ষিত বাহিনীকে হারিয়ে এ বারও জয় হল সেই কুয়ো শ্রমিকদেরই।

সোমবার ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সাড়ে আটটা। চার ঘণ্টা মাটির নীচে থাকার পরে দড়ি ধরে উপরে এলেন ৫৯ বছরের নিতাইচন্দ্র পাল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তোলা হল ৪০ ফুট নীচে আটকে থাকা কুয়ো শ্রমিক অমর পালের দেহ। ৩০ ঘণ্টা লড়াইয়ের পরে অবশেষে যে কাজে সক্ষম হল প্রশাসন। তবে তা সম্ভব হল স্রেফ রাজারহাট গঙ্গানগরের বাসিন্দা নিতাইবাবুর মতো ৩৫ বছর ধরে কাজ করা কিছু কুয়ো শ্রমিকের কৃতিত্বেই। রবিবার দমকল-সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষিত বাহিনী কাজ শুরু করেছিল অবশ্য। তবে যত রাত গড়ায়, তাঁরাও কার্যত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

রবিবার বিকেল ৩টে থেকে কুয়োয় আটকে থাকা অমরবাবুকে উদ্ধারের কাজ শুরু করেন কুয়ো শ্রমিকেরা। কাজটা নেহাত সহজ ছিল না। সতীর্থের দেহ তুলে আনার পরে নিতাইবাবু বলেন, “গা গোলাচ্ছিল, বমি আসছিল। তবুও মাটি কাটার কাজ করে গিয়েছি।” নিতাইবাবু জানান, রবিবার প্রশাসন প্রায় হাল ছেড়ে দেয়। তাঁরাই অমরবাবু তুলে আনবেন বলে এ দিন সকালে গাড়ি করে মধুগড়ে হাজির হন। প্রশাসনকে বলেন, “আমরা নামব। এক বার সুযোগ দিন।” এর পরে বিকেল থেকে প্রায় ৪০ ফুট নীচে ৪ ঘণ্টা ধরে মাটি কেটে গিয়েছেন নিতাইবাবু। তিনি জানান, নীচে অমরের একটি পা বালতি, দড়ি, কোদালের সঙ্গে আটকে ছিল, পুরো দেহটাই গেঁথে গিয়েছিল মাটিতে। মাটির নীচে এতটাই দুর্গন্ধ যে, কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দুর্গন্ধ থেকে সুস্থ রাখতে উপর থেকে বালতি করে লেবুপাতার জল পাঠানো হয় কুয়োর মধ্যে। সেই জল দিয়ে অমরবাবুর দেহ ভেজানো হচ্ছিল। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ অবশেষে দেহটি তুলে আনতে সক্ষম হন নিতাইবাবু। এই প্রথম কুয়োর প্রায় ৪০ ফুট নীচ থেকে কাউকে তুলে আনলেন তিনি। তাঁর আর্জি, রাজ্য সরকার তাঁর মতো অভিজ্ঞ কুয়ো শ্রমিকদের চাকরির ব্যবস্থা করলে তাঁদের কিছুটা সুরাহা হয়।

প্রায় দু’বছর আগে লিলুয়ার লক্ষ্মণপুরেও কার্যত একই ধরনের ঘটনায় একই ভাবে উদ্ধার হয়েছিল এক রাজমিস্ত্রির দেহ। সে বারও প্রশিক্ষিত বাহিনীর ব্যর্থতার পরে স্থানীয় কুয়ো শ্রমিকেরাই দেহ উদ্ধার করেছিলেন।

দু’বছর পরেও চিত্র বদলায়নি। মধুগড়েও রবিবার থেকে দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ) ও সিভিল ডিফেন্স এই চর্তুমুখী প্রচেষ্টাতেও কাজ হয়নি। সোমবার কার্যত হাল ছেড়ে দেওয়ায় তাঁদের ভরসা হয়ে দাঁড়ান মাটির তলায় আটকে থাকা অমরবাবুর সতীর্থরাই। তাঁদেরই পরামর্শে কুয়োর চার দিকে বেড় পরিয়ে মাটি ও জল তুলে আটকে থাকা শ্রমিকের দেহ উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হয়।

বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর বক্তব্য, তাঁরা মূলত জল, আগুন বা বিপজ্জনক বাড়ি থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। কুয়োর জলে পড়ে গেলেও তাঁরা কাউকে উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওই শ্রমিকের দেহ ৩৫ ফুটেরও বেশি গভীরে কাদামাটিতে আটকে ছিল। কুয়োর গভীরে মাটি কেটে দেহ উদ্ধারের প্রশিক্ষণ তাঁদের নেই। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর আইসি মির্জা ওহিউদ্দিন বেগ বলেন, “আমাদের কর্মীরা নীচে নেমেছিলেন। কিন্তু চার দিক থেকে নতুন করে ধস নামছিল। পাশ থেকে জল চুঁইয়ে ওই কুয়ো ভরে যাচ্ছিল। ফলে সোমবার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায়।”

রবিবার কপিকলের দড়ি বেঁধে অমরবাবুকে উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু উপর থেকে কপিকল টান দেওয়া মাত্র তাঁর মুখ থেকে রক্ত বেরোতে থাকে। এর পরে এক দিকে কপিকল ও বাঁশ দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চলে। কিন্তু তাতে উল্টে বাঁশ ভেঙে যায়।

এ দিন সকালে ফের দেহ উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হয়। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মী বিজয় বীর নীচে নামেন। তিনি বলেন, “প্রথম সাত ফুট বেড় পরানো। তার পরে প্রায় ৩০ ফুট পর্যন্ত ফাঁকা। চার দিকে নরম মাটি। সেখান থেকে নীচে আরও ৭ ফুট পর্যন্ত জল। তার নীচে কাদামাটিতে দেহটি আটকে ছিল। হাতের কিছুটা দেখা যাচ্ছিল।”

বিজয়বাবু জানান, আগের দিন ৩০ ফুট নীচে ছিল দেহটি। এ দিন আরও ৭ ফুট নীচে নেমে যায়। এ দিকে ক্রমশ জল বাড়ার পাশাপাশি কুয়োর কাদামাটিতে ধস নামতে থাকে। সেখানে থাকা বিপজ্জনক বলে তিনি উঠে আসেন।

দড়ি দিয়ে কার্যসিদ্ধি হবে না বুঝতে পেরে রীতিমতো নাকানিচোবানি অবস্থা হয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর। তখন কুয়ো শ্রমিকরাই বলেন, কুয়োর চার দিকে নীচ পর্যন্ত পোড়া মাটির বেড় দিতে হবে। তাতে ধস এবং জল আটকাবে। তার পরে কাদা ও জল ছেঁচে দেহ বার করতে হবে। সেই মতো দুপুর ২টো নাগাদ বেড় দেওয়া শুরু হয়। বিকেল ৩টে নাগাদ ঘটনাস্থলে যান এনডিআরএফের সদস্যেরা। কিন্তু তাঁরাও কোনও উপায় বার করতে পারেননি। উল্টে তাঁদের এক আধিকারিক আর কে মিশ্র বলেন, “যে পদ্ধতিতে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, সেটাই ঠিক। আমাদের নতুন কিছু করার নেই।” দেখা যায়, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেড় দেওয়াই চলছে। সেই সঙ্গে পাম্প ব্যবহার করে জল তোলা এবং বালতি দিয়ে মাটি তোলার কাজও চলতে থাকে।

দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীতে কিছু কুয়ো শ্রমিককে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। তাঁদেরকেই ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। কিন্তু বারবার ধস নামায় পরিস্থিতি জটিল হয়। ওঁরাও প্রাণের ভয়ে উপরে উঠে যান। তার পরে স্থানীয় কুয়োশ্রমিকদের সাহায্য নিই।” বিকেল ৫টা নাগাদ ঘটনাস্থলে যান দমদমের সাংসদ সৌগত রায়। সে সময়ে তিনি বলেছিলেন, “যারা আছেন, তাঁরা না পারলে সেনাকে ডাকব। কুয়ো তৈরির সময়ে ঠিকমতো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল কি না, তা পুলিশ দেখবে। আর ওই বহুতলের জমি সংক্রান্ত বিষয়টি দক্ষিণ দমদম পুরসভা খতিয়ে দেখবে।” এ দিনই কুয়োর ঠিকাদার সুনীল পাল ও বহুতলের প্রোমোটার লাল্টু দাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

সোমবার দিনভর উদ্বিগ্ন হয়ে কুয়োর পাশেই বসেছিলেন অমর পালের দুই ছেলে। দেহ মেলার পরে তাঁরা বলেন, মাটির নীচে নামানোর আগে যদি সব ব্যবস্থা করা হত, তবে এ ভাবে ধস নেমে তাঁদের বাবাকে মরতে হত না। এ ব্যাপারে ঠিকাদারদের গাফিলতি ছিল বলে অভিযোগ করেছেন দু’জনেই। ঘটনার প্রকৃত তদন্তের দাবি জানান তাঁরা।

বন্ধুকে মাটির তলা থেকে তুলে আনার পরে প্রশাসনের একাংশ নিতাইবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কী চান? জবাবে নিতাইবাবু বলেন, “জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারলাম না, অন্তত শেষ বারের মতো বন্ধুকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারব, এটাই সান্ত্বনা।”

অন্য বিষয়গুলি:

amar pal madhugarh accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy