নেইমার-হীন ব্রাজিলের শোচনীয় পরাজয়ে হতবাক এই খুদে সমর্থক।
খিদিরপুরে পাঁচ গোলের পরে রাতেই হতাশায় নেইমারের ছবিতে কালি লাগিয়ে দিয়েছিল কেউ।
হাওড়া ডুমুরজলার বেলাপোল অঞ্চলে পুড়েছে ব্রাজিল কোচ লুই ফিলিপ স্কোলারির কুশপুতুল। নরসিংহ দত্ত রোডে পুরো ব্রাজিল টিমের ছবিতে জুতোর মালা।
গাঙ্গুলিবাগান যুবক সঙ্ঘের উল্টো দিকে ব্রাজিল-পাড়ায় ঢুকলে মনে হবে যেন কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। চার দিক শুনশান। বাড়ির দরজা বন্ধ অথবা আধখোলা।
ব্রাজিল ম্যাচের দিন পিকনিক হতো, মাইক চালিয়ে গান। পাড়ার টিভিতে খেলা দেখার ভিড়টা জমাট বেঁধে থাকত শেষরাত পর্যন্ত। মঙ্গলবারের পরে সব ওলটপালট।
বেহালা চৌরাস্তার অক্ষয় পাল রোডে বেলো হরাইজেন্তের স্টেডিয়ামের রেপ্লিকা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাজিল ম্যাচের দিন কোন ফুটবলার কোথায় খেলবেন, সেই সম্ভাব্য ফর্মেশন তৈরি করে নেইমার-ফ্রেডদের ছবি বসিয়ে রাখা হত তাতে। যা দেখতে ভিড় করতেন আট থেকে আশির হলুদ-সবুজ সমর্থকেরা। রাত জেগে খেলা দেখাও চলত জমিয়ে।
একে ব্রাজিলের হার তার উপরে আবার নিজেরই পাড়ায় আর্জেন্তিনা সমর্থকদের খোঁচা। বুধবার সকালে, গাঙ্গুলিবাগানে।
বুধবার শহর ও শহরতলির ছবিটা অন্য রকম। ব্রাজিলের অপ্রত্যাশিত হার এবং সাত গোল হজমের ধাক্কায় যেন অর্ধেক কলকাতাতেই বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। সাম্বা ফুটবলের ঝলককে বরাবরই কুর্নিশ করেছে কলকাতা। পুজো করেছে পেলে-রোনাল্ডোদের। ১৯৮৬-তে মারাদোনা-ম্যাজিকে তাতে ভাগ বসিয়েছে আর্জেন্তিনা। তবু জার্সি বিক্রি, বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন এবং পথে-পথে তারকাদের ছবি-হোর্ডিং-সাজসজ্জায় এ বারও মনে হয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনার চেয়ে সমর্থনের বিচারে এগিয়ে নেইমারের ব্রাজিলই।
বেশি রাতে ব্রাজিল-জার্মানি ম্যাচ দেখতে জেগে ছিল কলকাতা। ফ্ল্যাটের সামনে টিভি লাগিয়ে, রাস্তার মোড়ে বা পার্কের জায়ান্ট স্ক্রিন ঘিরে ছিলেন হলুদ-সবুজ সমর্থকরা। এক গোল খেয়ে মাথায় হাত, দু গোলের পর উসখুস, তিন গোলের পরে খানিক পাতলা হতে থাকে জমাট ভিড়। ততক্ষণে হালতু বা বেহালায় অনেকেই দ্রুত মোবাইল বন্ধ করতে শুরু করেছেন। মূলত আর্জেন্তিনা বা জার্মানির সমর্থক বন্ধুদের কটাক্ষের হাত থেকে বাঁচবেন বলেই। জার্মানির পাঁচ গোলের পরে টিভি ভাষ্যকাররা যখন মজা করে বলছেন, ব্রাজিলের সব বাড়িতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে টিভি বন্ধ করে সবাই ঘুমোতে চলে গিয়েছেন, তার আগে এ শহরেও ঘুমের তোড়জোড়। আরও বেশি গোল খাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেরই চোখে জল! সঙ্গে আক্ষেপ, নেইমার-থিয়াগো সিলভা থাকলে এমনটা হত না।
চেতলার ব্রাজিল সমর্থকরা রাতারাতি মুলারের দেশের পতাকা ঝুলিয়েছেন পাড়ায়। তাঁদেরই এক জন বিমল দলুই বলছিলেন, “আমরা বাজে হেরেছি ঠিক আছে, কিন্তু আর্জেন্তিনাকে হারাতেই হবে। ওরা আমাদের শত্রু। সেটা পারবে জার্মানিই।” অনেকটা যেন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান বা সিপিএম-তৃণমূলের চেনা টক্কর।
গাঙ্গুলিবাগানের ব্রাজিল সমর্থক রিনা সামন্ত চাইছেন নেদারল্যান্ডস যাক ফাইনালে। উল্টো দিকেই আর্জেন্তিনা ফ্যান্স ক্লাবের মঞ্চ আলোয় ঝলমলে। সেখানে আঁধার নামলে খুশি হবেন রিনা। বলছিলেন, “আমরা হেরেছি, ওরাও হারুক।” পকেটের পয়সা খরচ করে গত দশ বছর পাড়া সাজাচ্ছেন বেহালা চৌরাস্তার রতন ও বাবলু হালদার। বলছিলেন, “মুখ দেখানো যাচ্ছে না। এই লজ্জা যাবে না কোনও দিন। দোকানে এসে সবাই আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত তাই ঘুমিয়ে ছিলাম বাড়িতে। খেলা দেখার মনটাই চলে গিয়েছে। ব্রাজিল নিয়ে আর মাতামাতি করব না।” বিমর্ষ গলা।
স্কুল-কলেজ-অফিস, পাড়ার দোকান থেকে উত্তর কলকাতার রক—পেলের দেশের মতোই আছড়ে পড়েছে আক্ষেপ, হা-হুতাশ। দুঃখ আর লজ্জার মিশেল হয়ে। সাও পাওলো, রিও বা পোর্তো আলেগ্রার বিরামহীন কান্নার সঙ্গে যেন মিশে যেতে চাইছে অর্ধেক কলকাতা। সমব্যথী হয়ে।
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy