নির্ধারিত ছিল নভেম্বর মাসে শহরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধের বিশ্লেষণ করা হবে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের ক্রাইম-বৈঠকে। বাস্তবে দেখা গেল, অন্য অপরাধ নিয়ে আলোচনা হলেও ওই মাসে শহরের বুকে ঘটে যাওয়া দু’টি বড় ঘটনার প্রসঙ্গই উঠল না সোমবারের বৈঠকে। আলিপুর থানা ভাঙচুর এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রাবাসে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে খুন দু’টিই নভেম্বরের ঘটনা। গত মাসের ক্রাইম-বৈঠকেও ওই দুই ঘটনা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। কথা ছিল, পরের অর্থাৎ এ বারের মাসিক ক্রাইম-বৈঠকে ওই দু’টি ঘটনা নিয়ে আলোচনা হবে।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ বারের মাসিক ক্রাইম-বৈঠকে তা না হওয়ায় অবাক কলকাতা পুলিশের নিচুতলার একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, আলিপুরের ঘটনায় সরাসরি শাসক দলের সমর্থক এবং নেতারা অনেকেই যুক্ত। ওই ঘটনায় এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলেও বাকি অভিযুক্তদের ব্যাপারে নিশ্চুপ পুলিশ। একই অভিযোগ কোরপান শাহ খুনের ক্ষেত্রেও। তিন জনকে গ্রেফতার করা হলেও মূল অভিযুক্ত ইন্টার্ন এবং হবু চিকিৎসকেরা এখনও অধরাই।
এ দিনের বৈঠকে পুলিশ কমিশনার এক বারও জানতে চাননি, কেন গত ১৪ নভেম্বর তৃণমূলের হামলার সময়ে আলিপুর থানার এক পুলিশকর্মীকে ফাইল হাতে টেবিলের তলায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কিংবা এনআরএস হাসপাতালে হবু চিকিৎসকদের হস্টেলে ১৬ নভেম্বর ভোরে গণপিটুনিতে কোরপান শাহ নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের কাউকেই কেন গ্রেফতার করা হল না? ওই দু’টি বিষয় নিয়ে কোনও তদন্তকারী ওসি-কেই পুলিশ কমিশনারের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি।
কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, এক বার কোরপান খুনের প্রসঙ্গ উঠলেও তা নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি বৈঠকে। লালবাজারের এক কর্তার বক্তব্য, এ দিন পুলিশ কমিশনার কোরপান শাহ খুনের জন্য গঠিত সিট-এর অফিসারদের কাছে জানতে চান, ওই মামলায় অভিযুক্তের গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে কি না। সেই সঙ্গে গোয়েন্দাদের ঘটনাটি ভাল মতো দেখতে বলেছেন।
কলকাতা পুলিশে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া অফিসারেরা বলছেন, ক্রাইম বৈঠকে সব সময়েই সাম্প্রতিক কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পাশাপাশি আগের মাসের সব অপরাধ নিয়ে আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক।
পুলিশের নিচুতলার অভিযোগ, আলিপুর থানায় হামলা এবং কোরপান শাহ খুন, দু’টি ঘটনাতেই শাসক দল এবং প্রাশাসনের চাপ রয়েছে পুলিশের উপরমহলের উপরে। আলিপুর-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত হলেন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ প্রতাপ সাহা। প্রতাপ এবং তাঁর সঙ্গীদের যাতে ধরা না হয়, তার জন্য আলিপুর থানার উপরে চাপ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পুলিশের নিচুতলার কর্মীরা। ওই ঘটনার তদন্ত ঠিকমতো না করায় আদালতে ভর্ৎসিত হতে হয়েছিল আলিপুর থানার তদন্তকারী অফিসারদের।
পাশাপাশি, কোরপান-কাণ্ডে মূল অভিযুক্তদের কাউকেই যাতে গ্রেফতার করা না হয়, তার জন্য চাপ রয়েছে তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেল এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের। এনআরএসের ছাত্রাবাসে কোরপান শাহ খুনের ঘটনায় জড়িত ৯ অভিযুক্তকে ধৃত প্রথম বর্ষের ছাত্র জসিমুদ্দিন চিহ্নিত করেছেন বলে লালবাজার সূত্রের খবর। অভিযুক্তদের বেশির ভাগ ওই ছাত্রাবাসের ইন্টার্ন ও হবু চিকিৎসক। যাঁদের নামও জানেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। কিন্তু ঘটনার দেড় মাস পরেও তাঁদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। পুলিশের নিচুতলার একাংশের অভিযোগ, ওই অভিযুক্ত ইন্টার্ন এবং হবু চিকিৎসকদের একাংশ শাসক দলের ঘনিষ্ঠ।
এ দিনের ক্রাইম-বৈঠকে অবশ্য পুলিশ কমিশনার শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য বলেছেন তাঁর অফিসারদের। বর্ষবরণের আগে শহরে নিরাপত্তা ঠিক রাখার জন্য তল্লাশির পাশাপাশি গোয়েন্দা-তথ্য জোগার করার দিকেও নজর দিতে বলা হয়েছে। এক পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন, কমিশনার রবিবারের বেঙ্গালুরু বিস্ফোরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শহরে প্রবেশ-পথগুলিতে আরও নিরাপত্তা-সহ তল্লাশি জোরদার করতে বলা হয়েছে।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে পার্ক স্ট্রিটের উদাহরণ টেনে গড়িয়াহাট, বড়বাজারের মতো জনবহুল এলাকায় সিসিটিভি-র নজরদারি বাড়াতে অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। শহরের বিভিন্ন হোটেল এবং গেস্ট হাউসে কারা আসছেন, তার দিকেও নজর দেওয়ার জন্য শহরের থানাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ক্রাইম-বৈঠকে বর্ষবরণের উৎসবে বাইকবাহিনীর উপরে নজর দিতে বলা হয়েছে পুলিশকর্তাদের। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “বড়দিনের আগের রাতে শহরে বেপরোয়া মোটরবাইক দুর্ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বার যাতে তেমন কিছু না হয়, তা নিশ্চিত করতে রাস্তার মাঝে গার্ডরেল বসিয়ে তল্লাশি চালাতে বলা হয়েছে।
এ দিকে, নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কলকাতা পুলিশ একটি মোবাইল ‘অ্যাপ’ চালু করছে। বিভিন্ন থানার ওসি-কে এ দিন সেই অ্যাপ-এর প্রচার করতেও বলেন নগরপাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy