Advertisement
১৮ জানুয়ারি ২০২৫
Kasba Attempt to Murder Case

কাঁচা টাকার রমরমা! তাই কসবা বারবার কুরুক্ষেত্র, দখলের রাজনীতিতে ফাঁকা প্লট ভিত্তি, বহুতল ভবিষ্যৎ

শুক্রবার সুশান্ত ওরফে স্বরূপকে যেখানে খুন করার চেষ্টা হয়, সেটি ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর বাড়ির সামনে। যেখান থেকে মেরেকেটে ৪০০ মিটার দূরে রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের বাড়ি। অদূরেই পরিচিত শপিং মল।

Vacant plots and high-rise buildings are behind the Kosba clash

কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে খুনের চেষ্টার পরে ফের আলোচনায় কসবার রাজনীতির ভিত্তি এবং ভবিষ্যৎ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৯
Share: Save:

উত্তর কলকাতার তৃণমূলে দলাদলি আছে। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ থাকে কথা কাটাকাটিতে। দক্ষিণ কলকাতাও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাইপাস লাগোয়া পূর্ব কলকাতা যেন এ কলকাতার মধ্যেই আর একটা কলকাতা। যেখানে বন্দুক, গুলি, বোমাবাজি কার্যত জলভাত। যার সর্বশেষ নিদর্শন শুক্রবার সন্ধ্যায় ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে গুলি করে খুনের চেষ্টা করা। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে পৌঁছে, বন্দুক তাক করার পরেও গুলি না বার হওয়ায় সুশান্ত প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রাণে বাঁচলেও পুলিশ-প্রশাসন তো বটেই, সার্বিক ভাবে তৃণমূলও ‘আলোড়িত’। সেই সূত্রেই আলোচনা শুরু হয়েছে, কেন কসবা বারবার কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠছে?

সম্প্রতি একাধিক বার উত্তপ্ত হয়েছে কসবা। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতৃত্ব যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেও মিটমাট করাতে পারেননি। শুক্রবার ফের সুশান্তকে খুনের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। সুশান্ত বলেছেন, ‘‘এর মধ্যে রাজনীতি নেই।’’ আবার তিনি এ-ও বলেছেন, বিরোধীরা এই কাজ করেছেন বলেও তিনি মনে করেন না। দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদের সদস্য দেবাশিস কুমারও দাবি করেছেন, ‘‘এতে রাজনীতি নেই। কিন্তু যা হয়েছে, সে ব্যাপারে প্রশাসন যা বলার বলবে।’’

তা হলে ঘটনা ঘটল কী কারণে?

প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতারা যা-ই বলুন, একান্ত আলোচনায় অনেকেই মানছেন, কাঁচা টাকার রমরমাই কসবাকে বার বার উত্তপ্ত করে তুলছে। যে কাঁচা টাকার উৎস মূলত ফাঁকা জমি। সেই জমিতে মাথা তোলা গগনচুম্বী বহুতল, সেই বহুতলে ব্যবহৃত ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেট। কলকাতার এই প্রান্ত এখন ‘উন্নয়নশীল’ এলাকা। বাড়ি, ফ্ল্যাট, কর্পোরেট সংস্থার অফিস গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘আমি যা জানি, তাতে আগামী পাঁচ বছরে কসবা এলাকায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গড়ে উঠবে।’’ পাশাপাশিই বাম আমলের ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ টেনে রসিকতা করেন, ‘‘ফাঁকা প্লট ভিত্তি, বহুতল ভবিষ্যৎ।’’

আশ্চর্য নয় যে, শাসকদলের সঙ্গে জড়িতেরা সেই ‘ভবিষ্যৎ’ সুরক্ষিত রাখতে চাইবেন। আশ্চর্য এ-ও নয় যে, সেই প্রয়াস ক্ষমতাসীন শিবিরের অন্দরে অস্ত্রের রাজনীতির জন্ম দেবে।

শুক্রবার সুশান্ত ওরফে স্বরূপকে যেখানে খুন করার চেষ্টা হয়, সেটি ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর বাড়ির সামনে। যেখান থেকে মেরেকেটে ৪০০ মিটার দূরে রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের বাড়ি। অদূরেই পরিচিত শপিংমল। যেখানে রাত পর্যন্ত লোকজন থাকেন। সেই জনবহুল জায়গায় এই রকম ঘটনা নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সুশান্তই ছিলেন এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কিন্তু গত পুর নির্বাচনে ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় সুশান্তকে তৃণমূল লড়তে পাঠায় পাশের ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ১০৭-এ প্রার্থী করা হয় লিপিকা মান্নাকে। দু’জনেই জিতেছেন। তার পর থেকেই কসবায় গোষ্ঠীলড়াই বেড়েছে বলে অভিমত অনেকের। কসবার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী জাভেদ খানের সঙ্গে সুশান্তর সম্পর্ক ‘মধুর’। আবার তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে লিপিকা ‘জাভেদের লোক’ বলে পরিচিত। যদিও শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে জাভেদ বা লিপিকা কেউই কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। তাঁদের একটাই কথা, প্রশাসন যা করার করবে।

বিরোধীরা তৃণমূল সম্পর্কে প্রায়ই বলে, পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন এলাকায় শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের যত আস্ফালন। পুলিশ পাশ থেকে সরে গেলে তাঁদেরও দাপট থাকবে না। কিন্তু কসবার রাজনীতির বিষয়ে ওয়াকিবহাল অনেকের বক্তব্য, পুলিশের একটি অংশ অনেক দিনই সুশান্তের ‘পাশে’ নেই। বরং তারা ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লিপিকার ‘পক্ষে’। অর্থাৎ জাভেদের পক্ষে। কসবা একটা সময়ে ছিল সিপিএমের ‘দুর্জয় ঘাঁটি’। এই ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডেই প্রতাপশালী সিপিএম নেতা স্বপন রায়কে হারিয়ে ২০১০ সালে কাউন্সিলর হয়েছিলেন সুশান্ত। কাউন্সিলর হিসাবে কিছু কাজ তাঁকে অল্প দিনেই ‘জনপ্রিয়’ করে তুলেছিল। তার মধ্যে অন্যতম কায়স্থপাড়া থেকে নস্করহাট পর্যন্ত খালের দু’ধারে রেলিং দেওয়া এবং পিচ ও পাথরের ব্লকের রাস্তা নির্মাণ। সামাজিক কর্মসূচিতেও গত ১৪ বছরে সুশান্ত ‘নিয়ন্ত্রণ’ কায়েম করতে পেরেছেন এলাকায়। তাঁর উদ্যোগে ‘পিঠেপুলির মেলা’ কসবায় অন্যতম পার্বণ। একদা রাজডাঙা নবোদয় সঙ্ঘের যে পুজো ছিল স্থানীয় সিপিএমের দুই নেতা দেবু-প্রশান্তের নামে খ্যাত, সেটি এখন ‘সুশান্তের পুজো’।

১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভিতরের সমীকরণেও বদল হয়েছে। সুশান্তের হয়ে যে বাহিনী কাজ করত, তাদের অনেকেই কোণঠাসা। তাদের জায়গায় মাথা তুলেছে সুশান্তের বিরোধী লিপিকার বাহিনী। সেই প্রশ্নেই পুলিশের ‘ভূমিকা’ নিয়ে আলোচনা রয়েছে শাসকদলের অন্দরে। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, নতুন ওয়ার্ডে জেতার পরেও সুশান্ত পুরনো ওয়ার্ডে ‘আধিপত্য’ কায়েম রাখতে চান। সেটাই সংঘাতের বীজ রোপণ করে দিচ্ছে বার বার। আবার শাসকদলের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে সুশান্ত নিজের মতো করে বাহিনী সাজিয়েছেন। সেখানে তিনি অন্যদের ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। সেটাও সংঘাতের একটি কারণ।

উপমা দিতে গিয়ে তৃণমূলের নেতারা সিপিএম জমানার সল্টলেক, ভিআইপি রোড লাগোয়া বাগুইআটি, তেঘরিয়া, জ্যাংড়া এলাকার কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, সল্টলেকে যখন মানুষের থাকতে যাওয়ার হিড়িক শুরু হয়েছিল, তখনও সেখানে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য চলছে। হুগলি শিল্পাঞ্চল থেকে হুব্বা শ্যামল, রমেশ মাহাতোরা চলে গিয়েছিলেন নতুন জনপদে। সল্টলেক এলাকায় হাতকাটা দিলীপের প্রতাপ নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বিস্তর আলোচনা ছিল। সেই আর্থসামাজিক দিক থেকেই কসবার কুরুক্ষেত্রকে দেখতে চাইছেন শাসকদলের অনেকে। এবং মনে করছেন, এখনই ‘রাশ’ টেনে না ধরলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটবে। কারণ, এই এলাকায় ‘ভবিষ্যৎ’ বহুতলই। যার ভিত্তি ফাঁকা প্লট এবং সেগুলির দখলদারি।

অন্য বিষয়গুলি:

Kasba Attempt to Murder Case kasba TMC Councilor Clsah Highrise
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy