মানুষের জটিল, রহস্যময় নির্মাণগুলির অন্যতম হল শহর। সমাজের ছায়ায় গড়ে উঠে এক সময় সে নিজেই হয়ে ওঠে সমাজের প্রতিবিম্ব। প্রাচীন ও নবীন সেখানে থাকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, যা দেখে শহরের গড়ে ওঠার ইতিহাসটা ধরা যায়। এ যেন এক চলমান জাদুঘর।
কিন্তু, তাকে তো দেখতে জানতে হয়। ১৯-২৫ নভেম্বর বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ উদ্যাপন করে ইউনেস্কো, দেশে দেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিরাপত্তা ও রক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে। দিল্লি আর্ট গ্যালারি মিউজ়িয়ামস (ডিএজি) তা পালন করছে একই সুরে। এ শহরে তার মূল উদ্যোক্তা কলকাতার ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং, আজ যা ‘ঘরে বাইরে’ নামের আশ্চর্য সংগ্রহশালা ও শিল্প-অভিজ্ঞতার পরিসর। ১৯ থেকে ২৮ নভেম্বর, দশ দিন ব্যাপী দুর্দান্ত শিল্প-ঐতিহ্য উৎসব তাদের, ‘দ্য সিটি অ্যাজ় আ মিউজ়িয়াম’ শিরোনামে। সঙ্গী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেনস-সহ এ শহরের আরও কয়েকটি শিল্প সংস্থা, ‘হেরিটেজ ওয়াক’ আয়োজক গোষ্ঠী, শিল্পী-বিশিষ্টজনও।
গঙ্গা, তার দু’পাশে অজস্র ঘাট, পুরনো বাগানবাড়ি, শিবপুরে প্রাচীন উদ্ভিদ উদ্যান, এ শহরের প্রাচীন সব পাড়া আর বহু স্থাপত্যকীর্তি, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্য— সবই কলকাতার অমূল্য শিল্প-ঐতিহ্য। এর কিছু রক্ষিত সংগ্রহশালায়, বাকি সবটাই ছড়িয়ে এ শহরে। গতকাল, ১৯ নভেম্বর শুরু হয়েছে সেই ঐতিহ্যের আস্বাদন, আউট্রাম ঘাট থেকে সান্ধ্য নৌকা ভ্রমণে ইউরোপীয় ভ্রামণিক-শিল্পীদের চোখে হুগলি নদীকে ফিরে দেখার প্রয়াসে। আজ দুপুর দেড়টা থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কর্মশালা ‘রিথিঙ্কিং স্পেসেস’— সৃষ্টিশীল কাজের জায়গা হিসেবে হেরিটেজ স্থানগুলির নতুন ব্যবহার নিয়ে— সঙ্গী ‘পিকল ফ্যাক্টরি’।
ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য কি শুধু জোড়াসাঁকো? গঙ্গার দুই পাড়ে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত ও শিল্প-ঐতিহ্য ফিরে দেখা এসে মিলবে শ্রীকান্ত আচার্যের গানে, পানিহাটির পুরনো বাগানবাড়ি ‘নীহার অন দ্য গ্যাঞ্জেস’-এ, কাল রবিবার, দুপুর ২টো থেকে সন্ধে ৬টা। ২৩ তারিখ সকাল ৯টা থেকে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা, উইলিয়াম রক্সবার্গের ছবিতে শিল্প ও প্রকৃতির সম্পর্ক-সন্ধান (ছবিতে জেমস বেইলি ফ্রেজ়ারের আঁকা রক্সবার্গ হাউস, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও গঙ্গা, উনিশ শতকে)। চিত্রকলায় মোগল মিনিয়েচার থেকে বেঙ্গল স্কুলের যাত্রাপথ দেখাবেন স্বরূপ দত্ত ও অর্ণব বসু; ‘ফ্রেমস অ্যান্ড পার্সপেক্টিভস’ অনুষ্ঠানে, ২৪ নভেম্বর বিকেল ৪টে থেকে ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়ামে। ২৫ তারিখ রাত ৮টায় ডালহৌসি-লালদিঘির ঐতিহ্যের খোঁজে হাঁটা, ২৭-এ দুপুর দুটো থেকে চিৎপুর-বটতলার একদা রমরমা ছাপাখানা ও স্টুডিয়ো শিল্পের খোঁজ পলা সেনগুপ্তের সঙ্গে। মেটিয়াবুরুজ হেঁটে ঘুরে, নবাবিয়ানায় সমৃদ্ধ শহরের কথকতার সাক্ষী হয়ে উৎসব-শেষ ২৮-এ।
স্মরণার্হ
১৯৩২-এ সংলাপে গানে অভিনয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে প্রাণ এনে দিল সবাক ছবি চণ্ডীদাস। পরিচালক দেবকীকুমার বসু (১৮৯৮-১৯৭১) (ছবিতে) এর পর সীতা তৈরি করে ভারতীয় ছবিকে পৌঁছে দিলেন বিশ্বে, ১৯৩৪-এ ভেনিস ফিল্মোৎসবে এল ‘অনারারি ডিপ্লোমা’। ১৯৫৯-এ বার্লিন উৎসবে দেখানো হয় সাগর সঙ্গমে। প্রথম জীবনে ম্যাজিক ল্যান্টার্ন প্রজেক্টরে ছবি দেখিয়েছেন, পরে নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক ছবিতে আসা। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রকবিতা ‘পূজারিণী’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘অভিসার’ ও ‘পুরাতন ভৃত্য’ অবলম্বনে তৈরি করেন অর্ঘ্য। করেছেন হিন্দি, মরাঠি তামিল, উর্দু ছবিও। ১৯৫৪ সালে তাঁর ছবি ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য তুমুল আলোড়ন তোলে। আজন্ম বৈষ্ণব ভাবধারায় মগ্ন এই চলচ্চিত্রকার মানবতার সাধনাই করে গিয়েছেন তাঁর ছবিতে। নভেম্বরেই জন্ম এই শিল্পীর, প্রয়াণও নভেম্বরেই। গত বুধবার তাঁর প্রয়াণের অর্ধশতক পূর্ণ হল।
শিশু উৎসব
স্কুল খোলার খুশির খবর এনেছে এ বার শিশুদিবস। সেই খোলা হাওয়ায় অহিংসার পাঠ শেখাল সুখচর পঞ্চম রেপার্টরি থিয়েটারের ‘২০২১ টিনের তলোয়ার’, ছোটদের নাট্যশিল্প মেলা। তপোবন শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্রে গত ১৪ নভেম্বর নাচ গান কবিতা নাটকের আসরে মাতল খুদেরা। পালাগানে অতিথি বন্ধুদল খড়দহের ‘শ্রুতিজাতক’, ন্যাজাট সুন্দরবন নাট্যউৎসব কমিটি। অন্য দিকে, সে দিনই সন্ধেয় শহরে মহাবোধি সোসাইটি হলে ‘আমপাতা জামপাতা উৎসব ২০২১’। কিশোর পত্রিকার উদ্যোগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, আড্ডায় হয়ে গেল দু’টি আলোচনাসভা। বিষয়— শিশুমনে অতিমারির প্রভাব প্রশমনে সাহিত্যের ভূমিকা, কেমন হতে পারে এই সময়ের আদর্শ কিশোরপত্রিকার উৎসব সংখ্যা।
মুক্তিযুদ্ধের ছবি
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর স্মরণে বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ এ বার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর, একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্তিতে শ্রদ্ধা ও স্মরণে শামিল এ শহরের পুরনো ফিল্ম ক্লাব সিনে সেন্ট্রাল-ও, নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে দু’দিন ব্যাপী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করেছে তারা। ২৪ ও ২৫ নভেম্বর বিকেল ৪টে ও সন্ধে ৬টায় দু’টি করে মোট চারটি ছবি— মেঘের অনেক রঙ, শ্যামলছায়া, আগুনের পরশমণি ও জয়যাত্রা। চারটি ছবিই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক; ১৯৭৬-এ তৈরি, হারুনর রশিদ নির্দেশিত মেঘের অনেক রঙ বাংলাদেশে পাঁচটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত আগুনের পরশমণি ও শ্যামলছায়া, তৌকির আহমেদ নির্দেশিত জয়যাত্রা-ও দর্শকধন্য, একগুচ্ছ পুরস্কারে সম্মানিত।
থিয়েটারচিত্র
থার্ড বেল পড়ার আগে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকেন না নাট্যপ্রেমী দর্শকদের একটা অংশ। চা-চপ সহযোগে আড্ডা চলে, আর হলের বাইরে সাজানো নাটকের নানা মুহূর্তের ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। কলকাতার থিয়েটারের দৃশ্য যাঁরা ক্যামেরাবন্দি করেন, তাঁদেরই এক জন কোয়েলা। গত উনিশ বছর ধরে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসাবে কর্মরত তিনি, যার মধ্যে আছে থিয়েটারের ছবি তোলাও। মেফিস্টো বা একলা চলো রে-র মতো দর্শকপ্রিয় মঞ্চায়নের আলোকচিত্র ধরা আছে তাঁর ক্যামেরায়। এ বছর বাংলা থিয়েটারের আদিপুরুষ গেরাসিম লেবেদেফ-এর ২৭২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কোয়েলাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে গোর্কি সদন, রুশ থিয়েটারের ছবির পাশে প্রদর্শিত হবে তাঁর তোলা বাংলা থিয়েটারের ছবি। আগামী ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর চলবে প্রদর্শনী, শনি-রবি বাদে। উদ্বোধন করবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শতবর্ষের শ্রদ্ধা
“শুধু চলচ্চিত্র সমালোচক এবং পরিচালকই ছিলেন না, চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্বন্ধেও গভীর জ্ঞান ছিল বাবার।”— চিদানন্দ দাশগুপ্ত (নীচে ছবিতে) সম্পর্কে অপর্ণা সেন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “চলচ্চিত্রের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ভালোবাসা ও সমাদরের নির্মাণে অবদান ছিল ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি ও চিদানন্দ দাশগুপ্তের।” ফিল্ম সোসাইটি পত্তনে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছিলেন, জন্মেছেনও দুজনে একই বছরে, ১৯২১। আজ, ২০ নভেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ হবে চিদানন্দ দাশগুপ্তের। তাঁর বই নয় ছবি-র বিশেষ জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ (সপ্তর্ষি) প্রকাশ পেল শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, তাঁর সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হচ্ছে চিদানন্দ দাশগুপ্তের গদ্যসংগ্রহ-র প্রথম খণ্ড (দে’জ)— নন্দন-২’এ, ২০-২১ নভেম্বর, দু’দিন ব্যাপী শতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে। প্রথম দিন চিদানন্দ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতাও দেবেন শমীক, ‘সিনেমা অ্যাজ় হিস্ট্রি’, মুখবন্ধে শ্যাম বেনেগাল। ‘চিদানন্দ দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে দেখানো হবে তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র। অন্য দিকে, ‘ফিপরেস্কি-ইন্ডিয়া’-র সর্বভারতীয় আন্তর্জালিক উদ্যোগে চিদানন্দ দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা দেবেন এম কে রাঘবেন্দ্র, ২০ নভেম্বর রাত ৮টায়।
আলাপচারী
সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসারে সর্বভারতীয় স্তরে আন্তরিক কাজ করছে ‘আখর’ সংগঠনটি। কলকাতার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিচিত নাম প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথ ভাবে গত বছর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে নানা কাজে যুক্ত তারা। তারই অঙ্গ হিসেবে আগামী ২৩ নভেম্বর, মঙ্গলবার, সন্ধে ৬টায় ‘দ্য কনক্লেভ’-এ তাদের এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের একত্র আয়োজিত নতুন অনুষ্ঠানে অতিথি মনোজ মিত্র। অভিনয়শিল্প ও সাহিত্যজগৎ, দুই পরিসরেই সমান কৃতী শিল্পীপ্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি তিনি। তাঁর নাট্যজীবন, পর্দায় অভিনয়ের নানা দিক এবং লেখালিখি নিয়ে আলাপচারিতায় থাকবেন আর এক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য। কোভিডবিধির কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠানটিতে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। তবে, প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ও ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে এই আলাপচারিতা সরাসরি শোনার সুযোগ থাকছে।
দেবী ও রক্ষী
জগদ্ধাত্রী পুজো পেরিয়ে গেল। শোভাবাজােরর বেনিয়াটোলায় অমৃতলাল দাঁ-এর সুদৃশ্য ঠাকুরদালানে দেবীপ্রতিমা, জয়া-বিজয়ার সঙ্গে দেখা গেল অস্ত্র হাতে দুই ঘোড়সওয়ারকেও (ছবিতে)। এরা কারা? অমৃতলাল দাঁ এস্টেটের তরফে অমরনাথ দাঁ জানালেন, এ হল পর্তুগিজ সৈনিকদের মূর্তি। কী ব্যাপার? বাংলায় ব্যবসা করতে আসা পর্তুগিজদের একাংশ জড়িয়ে পড়েছিল লুঠপাট, দাস ব্যবসা, দস্যুবৃত্তিতে। ফলে শাসকদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়, কমতে থাকে ব্যবসার সুবিধেও। ও দিকে ইংরেজ আর ফরাসিদের সঙ্গে বাণিজ্যের টক্করেও পিছু হঠে তারা। রোজগারের তাগিদে বহু পর্তুগিজ কাজ নিতে শুরু করেন বাংলার জমিদার ও বণিকদের কাছে। সাদা চামড়ার বলবান পর্তুগিজ রক্ষীও থাকত বহু পরিবারে। এমন পারিবারিক ইতিহাসেই হয়তো দাঁ বাড়ির বিচিত্র প্রতিমাপ্রথার উৎস।
অগোচর
দেড় বছর বাদে ক্লাস শুরু ইস্কুলে। প্রথমে উঁচু ক্লাস, পরে ফিরবে ছোটরা। অতিমারির ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের অন্য অভ্যর্থনার জন্য তৈরি সব স্কুল। দেওয়াল, মেঝে, দরজা, জানালা, পাঁচিল মেরামত হয়েছে, রং পড়েছে গায়ে। এত সবের মধ্যে বাকি স্কুল ভবনের মতো স্কুলের শৌচাগারও একই গুরুত্ব পেয়েছে কি? দীর্ঘ অবকাশে অনেক পড়ুয়া স্কুলছুট, তাদের, বিশেষত ছাত্রীদের ক্লাসে ফেরানোর অন্যতম শর্ত ব্যবহারযোগ্য, পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ শৌচালয়। সেটুকুও কি তৈরি? গতকাল পেরিয়ে যাওয়া বিশ্ব শৌচালয় দিবস এই প্রশ্নটা আর এক বার মনে করিয়ে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy