বাইরের চেহারাটা নেহাতই আটপৌরে। মামুলি একটা দু’কামরার বাড়ি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু ভিতরে ঢুকলে মনে হবে, ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিসে এসে পড়লাম!
এসি লাগানো ঘরে বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদি আঁটা রিভলভিং চেয়ার। দেওয়ালের তাকে সাজানো বিভিন্ন স্মারক। ঝুলছে ‘লোকাল বয়েজ’ সিন্ডিকেটের ক্যালেন্ডার। একটা ফ্রিজও মজুত!
সমীর সর্দার ওরফে ভজাইয়ের ‘অফিসঘরে’ আপনাকে স্বাগত।
নিউটাউনের সিন্ডিকেট-চাঁই ভজাই অবশ্য তাঁর ‘অফিসের’ সবচেয়ে বড় মাপের চেয়ারটিতে কখনও বসতেন না। দাবি করতেন, তৃণমূলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এক দিন এসে চেয়ারটিতে বসে গিয়েছেন। ‘‘তার পরে কি আর আমার ওতে বসা সাজে!’’— ঘরোয়া আসরে বিনীত ভাবে বলতেন সমীরবাবু। বারবার এ-ও জানাতে ভুলতেন না যে, কোনও সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাঁর যোগ নেই।
ওঁর কথার পিঠে কথা বলার মতো বুকের পাটা কারও হয়নি। কারণ, তিনি ‘ভজাই’। তল্লাটের সকলে জানেন, স্থানীয় বিধায়কের হাত রয়েছে তাঁর মাথায়। শাসকদলকে বহু ‘যুদ্ধে’ উতরানোর সেনাপতি ওই ঘরে বসে নিউটাউনের ইমারতি-সিন্ডিকেটের অর্ধেক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে তৃণমূলের একাংশের দাবি।
সাম্রাজ্যের বাকি অর্ধেক তা হলে কার? পুলিশ বলছে, তিনি হলেন হায়দর আলি মোল্লা। দাপটে তিনিও কম কিছু যান না। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, ভজাই যদি বিধায়ক-ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন, তো হায়দরের পাশে রয়েছেন স্থানীয় সাংসদ। তৃণমূলের গোষ্ঠী-রাজনীতিতে ওই বিধায়ক-সাংসদের পারস্পরিক সম্পর্ক এই মুহূর্তে কার্যত সাপে-নেউলে বলেই খবর রয়েছে রাজনীতিকদের মহলে।
তবে রাজনীতির গোষ্ঠী-বিন্যাসের অঙ্কে ভজাই-হায়দর দু’মেরুর বাসিন্দা হলেও আপাতত তাঁদের ঠিকানা একই— নিউটাউন থানার লক-আপ। তৃণমূলের দুই বিবদমান গোষ্ঠীর ছাতার তলায় থাকা এই দুই জাঁদরেল ‘সিন্ডিকেট-মাফিয়া’কে বুধবার সকালে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর পুলিশ। আদালত দু’জনকেই তিন দিন পুলিশ হেফাজতে রাখতে বলেছে। ‘‘নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওদের পাকড়াও করা হয়েছে।’’— জানিয়েছেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই।
পুলিশ-সূত্রের খবর, ভজাই-হায়দরকে ধরা হয়েছে অস্ত্র-আইনে। দু’জনেরই কাছে একটি করে রিভলভার ও কয়েক রাউন্ড করে কার্তুজ মিলেছে। কিন্তু দুই ‘বাহুবলী’র বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তো নতুন নয়। তা সত্ত্বেও তাঁরা দিব্যি ছিলেন! হঠাৎ ধরপাকড় কেন?
পুলিশের একাংশের ব্যাখ্যা: এ হল মুখ বাঁচানোর চেষ্টা। বাম জমানায় সংক্রমিত সিন্ডিকেট-অসুখ বাড়তে বাড়তে এখন দগদগে পচা ঘা। হাজার চেষ্টাতেও ঢেকে রাখা যাচ্ছে না, শাসকের গোষ্ঠী-কোন্দল মারফত বারবার বেরিয়ে আসছে। যার জেরে নিত্য মারামারি, খুন-জখম। শুধু নিউটাউন নয়, রাজ্যের সর্বত্র। কোথাও বালি খাদান নিয়ে কোথাও বা ইমারতির মাল ‘সাপ্লাইয়ের’ বরাতঘিরে রক্তগঙ্গা বইছে। এমনকী, রবিবার রাতে খাস কলকাতারই গড়িয়াহাটে ইমারতি সিন্ডিকেটের লড়াইয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে কয়েক জন জখম হয়েছেন!
বস্তুত পুলিশ ও তৃণমূলের একাংশের মতে, রোগের পচন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সিন্ডিকেটের আঁচ শাসকদলের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদেরও রেয়াত করছে না! খোদ শাসকদলের বিধায়ক সিন্ডিকেটের সমর্থনে সরব হচ্ছেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তিতে যেমন কালি লাগছে, তেমন বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে প্রকট হচ্ছে দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কদর্য চেহারা। নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, আমজনতাও ব্যাপারটাকে ভাল চোখে দেখছে না। তাই দু’পক্ষের দুই চাঁইকে হাজতে ঢোকাতে খাস নবান্নের শীর্ষ মহল থেকে নির্দেশ এসেছে বলে পুলিশ ও দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত।
অর্থাৎ, সঙ্কট সামলাতে আপাতত ‘ভরসা’র লোককে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত। তাতে কি অরাজকতায় দাঁড়ি পড়বে?
অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, পরিস্থিতি যা, তাতে পচন সারানো কার্যত অসম্ভব। ‘‘এই সব গ্রেফতারির উদ্দেশ্য হল এক গোষ্ঠীকে সরিয়ে
অন্য গোষ্ঠীর হাতে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া। কারবারও থাকল, আবার মানুষের কাছে প্রশাসনিক পদক্ষেপের একটা ছবিও তুলে ধরা গেল।’’— বলছেন শাসকদলেরই এক নেতা। বিধাননগরের এক পুলিশ-কর্তার কথায়, ‘‘ছোটখাটো অপারেশনে এ রোগ সারবে না। ভোটারদের কাছে ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা চলতে পারে। সাধারণ মানুষের বিশেষ লাভ হবে না।’’ কাজেই ভজাই-হায়দর হাজতে ঢুকলেও সিন্ডিকেট-রাজে লাগাম পড়ানো যাবে না বলেই পুলিশ-কর্তাটির অভিমত। স্থানীয় মানুষও বলছেন, ভজাই-হায়দরদের মতো প্রতাপশালীদের এখন হাজতে পুরলেও তাদের বাদ দিয়ে ভোট করার ঝুঁকি শাসকদল নেবে না।
বস্তুত বাম আমলেও এমনটা হামেশা দেখা গিয়েছে। পুলিশ-সূত্রের খবর: বাম আমলে নিউটাউন, থাকদাঁড়িতে গজিয়ে ওঠা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল গৌরের হাতে। তার শাগরেদ ছিল রুইস-ভজাই। পরে গৌর-রুইস ঝামেলায় দু’পক্ষের এলাকা ভাগ হয়ে যায়। আর বামেরা শক্তি হারাতেই আসরে নেমে পড়ে তৃণমূল। পালাবদলের আগেই ভজাই তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ক্রমশ গৌরের জায়গায় তিনিই হয়ে ওঠেন এলাকার ‘দাদা।’ নিউটাউন বলাকা আবাসনের পাশে যাঁর অফিসের দিকে যেতে হলে ষণ্ডা চেহারার যুবকদের জবাবদিহি করে যেতে হতো!
তবে নিউটাউনের ‘সোনার খনি’র দখল নিতে শাসকদলের একাধিক নেতা ঝাঁপিয়ে পড়ায় অঙ্কটা ক্রমে বদলে যায়। ভজাইকে রুখতে হায়দর-রুইসদের মতো কয়েক জনকে ছাতার তলায় আনে বিধায়কের বিরোধী গোষ্ঠী। দু’পক্ষের ঠোকাঠুকিতে শুরু হয় রক্তপাত, যার জেরে মারদাঙ্গার সব রেকর্ড ভেঙে নিউটাউন হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট-নগরী। তার এক-একটা অংশে এক-এক মাফিয়ার রাজত্ব। এবং প্রত্যেকের মাথায় শাসকদলের কোনও না কোনও নেতা-নেত্রীর ছত্রচ্ছায়া! কী রকম?
এলাকার খবর: পালাবদলের পরে দীর্ঘ দিন নিউটাউনে সিন্ডিকেটের সিংহভাগ ভজাইয়ের হাতের মুঠোয় ছিল। কারণ, মুকুল রায় যত দিন দলে ক্ষমতাশালী ছিলেন, তত দিন নিউটাউনের মুকুল-ঘনিষ্ঠ বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের দাপট ছিল বেশি, আর তাঁরই মদত ছিল ভজাইয়ের পিছনে। তাই পুলিশ ভজাইকে বিশেষ ঘাঁটাত না।
‘‘কিন্তু মুকুল এখন দলে কোণঠাসা। তাই তাঁর ঘনিষ্ঠদেরও দাপট কমেছে। সেই ফাঁকে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের ঘনিষ্ঠ হায়দরেরা।’’— দাবি দলীয় এক সূত্রের।
ফলে নিউটাউনে সিন্ডিকেট-ক্ষমতার সমীকরণও বদলে গিয়েছে। তাতেই বেড়েছে বিপত্তি। এক পুলিশ-কর্তার বিশ্লেষণ, ‘‘সপ্তাহ দুয়েক আগে ভজাই ও হায়দর গোষ্ঠীর গোলমাল বেধেছিল। তখনই বোঝা যায়, হায়দরেরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।’’
সংশ্লিষ্ট বিধায়ক ও সাংসদের কী বক্তব্য? দু’জনেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের কোনও গোষ্ঠী নেই। আমাদের একটাই ছাতা— তৃণমূল। এক জনই নেত্রী— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ আর বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের মন্তব্য, ‘‘এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে প্রশাসন যথাযথ কাজ করেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy