Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
T. M. Krishna

রবীন্দ্রগানের বিস্মৃত কলিতে স্বদেশের খোঁজ

কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঙ্গিকে রবীন্দ্রগানটির উপস্থাপনা কৃষ্ণের কাছে দেশের ভুলে যাওয়া আদর্শের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ারই চেষ্টা।

প্রতিবাদী: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে টি এম কৃষ্ণ (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

প্রতিবাদী: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে টি এম কৃষ্ণ (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৫৮
Share: Save:

জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’-এর মূল গানটির ‘অশ্রুত’ অংশ এখন ধর্মাচরণের মতো গোটা দেশের সামনে মেলে ধরছেন তিনি। শুক্রবার দেশের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সঙ্গীত-সন্ধ্যায়ও তার ব্যতিক্রম হল না। কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী টি এম কৃষ্ণ কলকাতাকে বললেন, ‘‘গানটির না-গাওয়া স্তবকগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে এ দেশের ভুলে যাওয়া আদর্শের কথা। গানটি একই সঙ্গে কিছু ভুলে যাওয়া কিংবা ভুলতে না-পারা প্রান্তিকতাকে মনে করায়।’’

কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার মধ্যে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশের ভিতরে জাতধর্মের দেওয়াল ভাঙতে একনিষ্ঠতার জন্য ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছিলেন কৃষ্ণ। এ বার কলকাতায় এসে নানা উপলক্ষে বারবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক বা আঞ্চলিক স্বর উদ্‌যাপনই যে সময়ের দায়, তা বুঝিয়ে গেলেন তিনি। জাতীয়তাবাদী বা দেশপ্রেমিক হিসেবে কিন্তু নিজেকে কখনও দেখেনইনি কৃষ্ণ। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে ক্ষোভ-রাগ তাঁকেও অন্য ভূমিকায় উপস্থাপিত করছে। ডিসেম্বরেই চেন্নাইয়ে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদে শামিল হওয়ার দরুণ আইন অমান্যের অভিযোগে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল পুলিশ।

কলকাতায় নেতাজি ভবনে সুভাষ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও জনগণমন-র খানিকটা অপরিচিত অংশ, ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী / হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী’ থেকে ‘তব করুণারুণ রাগে নিদ্রিত ভারত জাগে’-র কিছুটা গেয়েছেন তিনি। কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঙ্গিকে রবীন্দ্রগানটির উপস্থাপনা কৃষ্ণের কাছে দেশের ভুলে যাওয়া আদর্শের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ারই চেষ্টা। তবে মজার ব্যাপার, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রস আস্বাদনে গানের বাণী নয় ধ্বনিগত শব্দই শেষ কথা বলে মানেন কৃষ্ণ। এ যাত্রা, ভিক্টোরিয়ায় কলকাতা লিটারারি মিটের আসরে আলোচনা এবং সঙ্গীত উপস্থাপনার ফাঁকেও শিল্পী-সমাজকর্মী কৃষ্ণ এই মতেই স্থিত হয়েছেন।

আরও পড়ুন: এ বাড়ির প্রার্থনায় জনসমাগম সামলাতে চলত বিশেষ ট্রেন

কিন্তু কেন? ধ্বনিই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নান্দনিক মাপকাঠি হলে বাংলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষার উত্তরাধিকারে কেন হাত পাতেন কৃষ্ণ? এ প্রশ্নের জবাবে শিল্পী স্মিত হাসলেন, ‘‘ধ্বনিকে গুরুত্ব দিলেও অনেকের কাছেই ভাষা যে অভিব্যক্তির মাধ্যম সেটা এখন বুঝি। এক বার এক জন বলেছিলেন, ধ্বনিই সঙ্গীতের সব হলে চরম হিংসা, বিদ্বেষে ভরপুর বাণী কি সুরে ফেলে গাইবেন আপনি? তখন থেকেই ধন্দে আছি। তাই ভাষাগত শব্দের অভিঘাত, প্রেক্ষিত, অর্থের ব্যঞ্জনা এখন অস্বীকার করি না।’’ রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-তুলসীদাস থেকে শুরু করে তামিলে বন্ধু পেরুমল মুরুগানের কবিতা, তামিল-মালয়ালম-হিব্রু-সংস্কৃতের নানা উপস্থাপনা তাঁর শিল্পের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। প্রধানত, হিন্দু দেবদেবীদের স্তুতিতে ভরপুর কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানায় যা এক ধরনের অন্তর্ঘাত বলে মনে করেন রসিক সঙ্গীতবোদ্ধারা।

কর্নাটকি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান বাদ্যযন্ত্র মৃদঙ্গ তৈরির নেপথ্য-কাহিনি নিয়ে তাঁর বই প্রসঙ্গে কলকাতার সাহিত্য উৎসবে বলতে এসেছিলেন কৃষ্ণ। আড্ডায় আইনজীবী-সঙ্গীতলেখক অরুণাভ দেব নানা প্রসঙ্গ উস্কে দিচ্ছিলেন। গরুর চামড়া দিয়ে হিন্দু, খ্রিস্টান কারিগরদের মৃদঙ্গ তৈরির খুঁটিনাটি নিয়ে প্রধানত ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত শিল্পীদের নানা অস্বস্তির কথা তাতে উঠে এল। কৃষ্ণ বললেন, ‘‘মৃদঙ্গকে (শিবের বাহন) নন্দীর ধ্বনি বলা হয়। আবার মৃদঙ্গই নন্দীর মৃত্যুর কারণ।’’

মৃদঙ্গ নির্মাতাদের প্রান্তিক স্বর থেকে দেশের অস্থির সময়ে উঠে আসা প্রতিবাদের নানা প্রান্তিক স্বরে এখন মজে আছেন কৃষ্ণ। তেতে ওঠা প্রতিবাদ-নগরী কলকাতায় পার্ক সার্কাস বা অন্যত্র অবশ্য যাওয়া হয়নি শিল্পীর। সেখানে গেলে কী গান গাইতেন? কিছু দিন আগে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের ‘হম দেখেঙ্গে’র তামিল সংস্করণটিও মুগ্ধ হয়ে টুইট করেছেন কৃষ্ণ। এ দিন বললেন, ‘‘যে কোনও গানই প্রতিবাদের গান হয়ে উঠতে পারে। যেমন এখনই গাইলাম জনগণমন-র অংশ।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy