জনসেবা: রাতে এসএসকেএমের বাইরে রোগীর পরিজনদের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
তাঁর একটা স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নকে আঁকড়ে এগিয়ে যাওয়ার লড়াইও আছে। লড়াইয়ে শামিল প্রতিদিনের যোদ্ধাদের আগলে রাখতে এখানে অবশ্য কোনও আগ্রাসনের গল্প নেই। আছে শুধু পাশে থাকার ভরসা। তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘরের।
যে রান্নাঘর দিনে ষোলো ঘণ্টা সরকারি হাসপাতালগুলোয় ঘুরে ঘুরে রোগীর পরিবারকে রান্না করা খাবার বিতরণ করবে। রোগীর প্রেসক্রিপশন বা কার্ড দেখালে সেই খাবার মিলবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই পরিকল্পনা সরকার বা কোনও সংস্থার নয়, সাধারণ এক সহ-নাগরিক দেখেছেন এমনই স্বপ্ন। বিনামূল্যে খাবার বিতরণের তাঁর এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে।
ওই বছর সরকারি হাসপাতালে নিজে ভর্তি ছিলেন কালীঘাটের বাসিন্দা, পার্থ করচৌধুরী। পেশায় পুলকার চালক পার্থ দেখেন, সরকারি হাসপাতালে রোগীর খাবার ভাগ হয়ে যায়। তাঁর বরাদ্দের খাবার হাসপাতালে থাকা পরিজনেদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন রোগী। বার বার দেখে বিষয়টি নাড়া দিয়েছিল পার্থকে। রোগীর পরিজনেদের জন্য কিছু করা যায় কি না, ভাবতে শুরু করেছিলেন তখনই। সুস্থ হয়ে ফেরার পরে ঘরে বসেই পার্থ ঠোঙায় চিঁড়ে-মুড়ি, গুড়, কলা ভরে রাতে হাজরার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে চলে যেতেন। চত্বরে শুয়ে থাকা রোগীর পরিজনেদের হাতে তুলে দিতেন সেই ঠোঙা। কিন্তু ২৫-৩০ জন মানুষের হাতেই উঠত সেই খাবার। চেয়ে থাকত আরও অনেক অভুক্ত মুখ। তাঁদের সেই প্রতীক্ষার চাহনিই আরও চাগিয়ে তুলেছিল পার্থর ইচ্ছেটা।
তিনি রাতের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে খেয়াল করেন, খাবারের দোকানগুলো উদ্বৃত্ত খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দেয় অথবা ভবঘুরেদের দিয়ে দেয়। পার্থ কথা বলা শুরু করলেন দোকানগুলোর সঙ্গে। একে একে সাতটি খাবারের দোকান রাজি হল তাঁকে উদ্বৃত্ত খাবার দিতে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পার্থ খাবার সংগ্রহ করতেন। প্রথমে এসএসকেএম, পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল এবং শেষে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে সেই খাবার পৌঁছে দিতেন পার্থ। ২০২০ সালে লকডাউন পর্বে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফের শুকনো খাবার বিতরণ করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবিরও শুরু করেন।
লোকমুখে ‘হসপিটাল ম্যান’ পার্থের কাজের কথা ছড়িয়ে পড়ায় এগিয়ে আসেন অনেকেই। চাল, ডাল, তেল, আলু দিয়ে সাহায্য করতে থাকেন। এখন পাড়ারই দু’জন ছেলেকে টাকার বিনিময়ে রান্নার কাজে রেখেছেন পার্থ। দু’বছর ধরে সকালে ভাত, ডাল, তরকারি ও রাতে রুটি, তরকারি পরিবেশন করছেন তিনি। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে খাবার নিয়ে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে যান। বিকেলে ফের যান সেখানে। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ এসএসকেএমের দু’টি গেটে রোগীর পরিজনেদের খাবার দেন তিনি।
তবে একটি অনুযোগ আছে পার্থের। এই কাজ করতে গিয়ে বার বার হাসপাতালের পুলিশ পোস্টে তাঁকে হেনস্থা হতে হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর। সেই ঝক্কি কমলে ভাল হত, জানাচ্ছেন পার্থ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার স্বপ্ন ছিল কমিউনিটি কিচেন গড়ে অভুক্ত মানুষগুলোর জন্য কিছু ব্যবস্থা করা। তাতে দেখলাম, অনেক খরচ। চেষ্টা করছি একটি ছোট মালবাহী গাড়িকে সম্পূর্ণ রান্নাঘরে বদলে নেওয়ার। তা হলে ষোলো ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে অনেক রোগী ও তাঁদের পরিজনকে খাবার দিতে পারব। তবে মানুষের সাহায্য পেলেই এই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।’’
আর তাঁর পেশা? পেশার সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছেন পার্থ। চাকুরে স্ত্রী এবং মেয়ের পূর্ণ সহযোগিতায় তাই এখনও বেঁচে রয়েছে তাঁর ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘরের স্বপ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy