Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Garden Reach Building Collapse

গার্ডেনরিচকাণ্ড কি আবার প্রকাশ্যে তৃণমূলে উত্তর-দক্ষিণের ‘তুলনা’? চাপানউতরে দলেই জল্পনা

তৃণমূলের উত্তর কলকাতার নেতারা নিজেদের দক্ষিণের নেতাদের তুলনায় ‘প্রান্তিক’ বলে মনে করেন। তৃণমূল চার বার পুরসভা দখল করলেও মেয়রের পদে বসেছেন সেই নেতারাই, যাঁদের কর্মভূমি দক্ষিণ কলকাতা।

Graphical Representation

ফিরহাদ হাকিম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অতীন ঘোষ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

অমিত রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ ০৯:০৯
Share: Save:

রবিবার গভীর রাতে গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনায় ‘ঘরে-বাইরে’ অস্বস্তিতে শাসকদল তৃণমূল। এক দিকে তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরবোর্ডের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে জনমানসে। অন্য দিকে, দলের উত্তর-দক্ষিণ ‘বিভাজন’ আবার প্রকাশ্যে এসে পড়েছে বলেই জল্পনা শুরু হয়েছে দলের অন্দরে। এমনিতেই তৃণমূলকে ‘দক্ষিণ কলকাতার’ দল বলে কটাক্ষ করে থাকেন বিরোধীরা। তার কারণও যে একেবারে নেই, তা নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান দক্ষিণ কলকাতা থেকেই। তখন থেকেই সেটি তাঁর ‘ঘাঁটি’ বলে পরিচিত।

ঘটনাচক্রে, মমতার দলের দ্বিতীয় প্রজন্মের দায়িত্ব যাঁর হাতে ন্যস্ত, যাঁকে তৃণমূল তাদের ‘সেনাপতি’ হিসেবে মেনে নিয়েছে, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দক্ষিণ কলকাতারই বাসিন্দা।

দীর্ঘ সাড়ে চার দশকেরও বেশি মমতার নজরে দৃশ্যতই দক্ষিণ কলকাতা বেশি ‘গুরুত্ব’ পেয়ে এসেছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী (তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরও দক্ষিণ কলকাতাতেই) হওয়ার পরে একটা সময়ে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়কই রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। কোনও একটি লোকসভা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বস্তুত, তখন শোভন চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রীর পাশাপাশি কলকাতার মেয়রও ছিলেন। তিনি দল এবং পদ ছাড়ার পরে যখন মেয়র পদে নতুন কাউকে প্রয়োজন হল, তখন বিধানসভায় বিল এনে নতুন আইন প্রণয়ন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে কলকাতার মেয়র করেছিলেন।

তখনই মেয়র পদের ‘দাবিদার’ হিসেবে দলের অন্দরে নাম উঠে এসেছিল অতীন ঘোষের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মেয়র হননি। দলের অন্দরে একাংশ মনে করেন, উত্তর কলকাতার রাজনীতিক বলেই অতীনের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। তবে অতীনকে একেবারে খালি হাতেও ফেরানো হয়নি। তিনি এখন ডেপুটি মেয়র। গার্ডেনরিচের ঘটনার পরে ‘উত্তরের’ অতীন প্রকাশ্যেই ‘দক্ষিণের’ ববির বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। ‘উত্তরের’ অতীনের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন ‘উত্তরেরই’ নেতা কুণাল ঘোষ।

সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূলের অন্দরের উত্তর-দক্ষিণ সমীকরণ আবার প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। এমনিতেই তৃণমূলের উত্তর কলকাতার নেতারা নিজেদের দক্ষিণের নেতাদের তুলনায় ‘প্রান্তিক’ বলেই মনে করেন। কারণ, তৃণমূল চার বার কলকাতা পুরসভা দখল করলেও মেয়র পদে বার বার বসেছেন দক্ষিণের নেতারাই। একাধিক মেয়র পারিষদ থাকলেও জল-নিকাশি-পূর্ত-পার্কিং-বিল্ডিং-কর আদায়ের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্বেও থেকেছেন দক্ষিণের কাউন্সিলররাই। তৃণমূলের তিন বারের সরকারে দক্ষিণ কলকাতার বিধায়ক বা বাসিন্দা বিধায়কেরা যখন রাজ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন, তখন উত্তর কলকাতার বিধায়কদের মধ্যে রাজ্য মন্ত্রিসভায় বর্তমানে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে মাত্র এক জনের। শ্যামপুকুরের বিধায়ক শশী পাঁজা।

তবে উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূলের লোকসভার নেতা করেছেন মমতা। যদিও রাজ্যসভার নেতা করা হয়েছে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে। অনেকে বলেন, উত্তর কলকাতার নেতা বলেই অধুনা বিজেপি তাপস রায়ের ভাগ্যে সেই ভাবে মন্ত্রিত্বের শিকে ছেঁড়েনি।

ঘটনার পর প্রথম থেকেই এলাকার কাউন্সিলরকে মেয়র ববি ‘আড়াল’ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার দিন রাতেই গার্ডেনরিচের ব্যানার্জিপাড়া এলাকায় পৌঁছে যান মেয়র। ওই এলাকাটি তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র কলকাতা বন্দরের মধ্যেই পড়ে। সোমবার সকালে সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। জনতা কাঠগড়ায় তোলে কলকাতা পুরসভাকে। সঙ্গে প্রোমোটার এবং ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শামস ইকবালকেও ওই বেআইনি নির্মাণের জন্য দায়ী করেন স্থানীয়েরা। কিন্তু শামসের পক্ষ নিয়ে মেয়র বলেন, ‘‘কাউন্সিলরের কাজ কোন এলাকায় জল নেই, কোন এলাকায় লাইট নেই, ড্রেনেজ সিস্টেম খারাপ, সেটা দেখা। অবৈধ নির্মাণ দেখা কাউন্সিলরের কাজ নয়। এটা দেখার কাজ বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকদের। যাঁরা মাইনে পান। আমরা তাঁদের শোকজ় করেছি। ভিতের সময়েই যদি ধরা যায় তা হলে এগুলো হয় না।’’ ঘটনাচক্রে, কলকাতা পুরসভায় বিল্ডিং বিভাগের মেয়র পারিষদ ববি স্বয়ং। যিনি বেআইনি নির্মাণকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলেছেন।

মেয়রের ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ডেপুটি মেয়র অতীন বলেন, ‘‘আমি শুনেছি, উনি (মেয়র) ওই অবৈধ নির্মাণের কথা জানতেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি কোনও এলাকার কাউন্সিলর হতাম আর আমার এলাকায় যদি এমন ঘটনা ঘটত, তা হলে আমি ওই ঘটনার দায় এড়াতে পারতাম না।’’ মেয়রের কাউন্সিলরের পাশে দাঁড়ানোর সমালোচনা করে অতীন আরও বলেন, ‘‘যে চেয়ারে বসে, নিয়ন্ত্রণের দায় তার। আমার ওয়ার্ডে হলে দায় এড়াতে পারতাম না। আমাকেও ব্যাখ্যা দিতে হত। যদি কেউ চেয়ারে থাকেন, তা হলে তাঁর এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে নৈতিক দায় নিতে হবে।’’ অতীনের মন্তব্যকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করেন কুণাল।

সেই সূত্রেই তৃণমূলের অন্দরে আবার উত্তর-দক্ষিণ ‘তুলনা’ শুরু হয়েছে। যদিও দলের কোনও নেতাই প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। সকলেরই একসুর: ‘‘আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy