ভর্তির প্রতীক্ষায় মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা নার্গিসা খাতুন বিবি (বাঁ দিকে)। খাগড়াগড় থেকে আসা ফতেমা খাতুনের জোটেনি শয্যা (ডান দিকে)। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
‘রেফার’ করার ব্যাধি সারে না, শয্যা না-থাকার কারণ দেখিয়ে রোগী ফেরানোও ঘটতেই থাকে। এর মধ্যেই আবার চলে দালাল-চক্র। সরকারি হাসপাতালের এই দৈন্য কি ঘুচবে না কোনও দিন?
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (এন আর এস) নার্সেস বিল্ডিংয়ের এক পাশে চলছে রাস্তা সংস্কারের কাজ। সেখানেই ধুলোবালির মধ্যে একটি ট্রলিতে পড়ে ধুঁকছেন এক মহিলা। পায়ে কোনও মতে প্লাস্টার করা। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে এসেছে। গোঙাতে গোঙাতে মাঝেমধ্যেই বলছেন, ‘‘উফ, আর তো পারছি না! আর কত ক্ষণ?’’ সে দিকে নজরই নেই ট্রলির সামনে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে মাটিতে বসে পড়া ব্যক্তির।
কী হয়েছে ওঁর? প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে মহম্মদ সেলিম সরকার নামে সেই ব্যক্তি বললেন, ‘‘কী আর হবে? মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।’’ চোখ লাল, মুখে রাতভর ঘুম না হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। এর পরে ওই ব্যক্তি বললেন, ‘‘এখানে ভর্তি নেবে কি না, জানি না। অন্য কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই। অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া দিতে গিয়েই সঙ্গে যা টাকা ছিল, সব শেষ।’’
বছরের পর বছর যায়, শহরের সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগীর পরিবারের এমন অসহায় অবস্থার
চিত্র বদলায় না। এন আর এস হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেল, এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বহু রোগীর পরিবারই অসহায় অবস্থায় দিনভর ছুটে বেড়াচ্ছে চিকিৎসা পাওয়ার আশায়। এক ভবন থেকে আর এক ভবনে ছুটে কোনও রোগীর পরিবারকে শুনতে হচ্ছে, শয্যা ফাঁকা নেই। কাউকে আবার বলা হচ্ছে, চিকিৎসক আসেননি, পরের তারিখে আসুন।
পেশায় হকার সেলিম যেমন জানালেন, তাঁদের বাড়ি মুর্শিদাবাদের ডোমকল এলাকায়। মঙ্গলবার সকালে তিনি কাজে থাকাকালীন হঠাৎ খবর আসে যে, তাঁর স্ত্রী, বছর তেত্রিশের নার্গিসা খাতুন বিবি ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছেন। দ্রুত তাঁকে ডোমকল সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে রেফার করা হয় মুর্শিদাবাদ জেলা হাসপাতালে। সেলিম বললেন, ‘‘মুর্শিদাবাদ হাসপাতাল বলল, নার্গিসার কোমর এবং পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছে। মাথাতেও রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে পায়ের এবং কোমরের চিকিৎসা করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর বেশি কিছুই এখানে হবে না। কলকাতার নীলরতনে নিয়ে যান।’’ সেলিম জানান, ওই কথা শোনার পরে রাতেই তাঁরা অ্যাম্বুল্যান্সে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল ৬টা নাগাদ এন আর এসে পৌঁছন। তার পর থেকেই হয়রানির শুরু।
সেলিমের দাবি, সকাল ৬টায় এসে তাঁদের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয় ট্রলি পাওয়ার জন্য। তত ক্ষণে অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া সাড়ে ছ’হাজার টাকা হয়ে গিয়েছে। ফলে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রোগীকে শোয়াতে হয় রাস্তাতেই। এর চার ঘণ্টা পরে, সকাল ১০টা নাগাদ একটি ট্রলি পান তাঁরা। তার পরে সেই ট্রলিতেই শুরু হয় অপেক্ষা। সেলিম বলেন, ‘‘চার ঘণ্টা লাইন দেওয়ার পরে আধার কার্ড জমা দিয়ে একটা ভাঙা ট্রলি পেয়েছি। সেটা নিয়ে চলাও যায় না।’’
একই রকম ভুক্তভোগী বছর তিনেকের কন্যা ফতেমা খাতুনকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসা বাবা নবাবুল শেখ। তিনি জানান, বর্ধমানের খাগড়াগড়ে তাঁদের বাড়ি। মঙ্গলবার দুপুরে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায় ফতেমা। মুখে গুরুতর চোট লাগে। গভীর চোট রয়েছে চোখেও। বর্ধমান জেলা হাসপাতাল জানিয়ে দেয়, সেখানে চোখের চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থা নেই। এন আর এস হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে এসে আহত শিশুটিকে নিয়ে এক ভবন থেকে আর এক ভবনে ছুটে বেড়ানোর পরে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, সিটি স্ক্যানের যন্ত্র খারাপ। অন্য দিন আসতে হবে। বিকেল ৪টে পর্যন্ত বসিয়ে রেখে আগামী সপ্তাহের তারিখ দেওয়া হয়।
ওই হাসপাতালের সুপার ইন্দ্রাণী দে অবশ্য পরিস্থিতি মেনে নিয়েই বললেন, ‘‘কিছু সমস্যা তো থাকেই। ইচ্ছে করে কাউকেই ফেরানো হয় না।’’ সেই সঙ্গেই তাঁর দাবি, ‘‘শয্যার প্রচণ্ড চাপ থাকায় রোগীদের ট্রলিতে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। ফলে সামান্য ট্রলি পেতেও ভোগান্তি হচ্ছে।’’
স্ত্রীকে নিয়ে হয়রান সেলিম দিনের শেষে বললেন, ‘‘একাধিক পরীক্ষার পরে জানানো হয়, শয্যা ফাঁকা নেই। অন্য হাসপাতালে দেখুন, নয়তো ট্রলিতেই থাকুন। শয্যা ফাঁকা হলে জানানো হবে! এ যেন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা!’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy