ফাইল চিত্র।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। শত্রুপক্ষের বোমায় আমাদের একের পর এক ক্যান্টনমেন্ট পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছে। সামনের সারির প্রায় অর্ধেক যোদ্ধা নত হয়েছেন। বেশ কয়েক জন প্রধানও ইতিমধ্যেই নতি স্বীকার করেছেন। আমরাও যে কোনও মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারি। সামনের পথ অতি দুর্গম।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার হিসাবে গত কয়েক দিন ধরেই সংক্রমণের বৃদ্ধি খুব কাছ থেকে লক্ষ করছি। ইতিমধ্যেই গোটা হাসপাতালের মোট ৫৮ জন চিকিৎসক সংক্রমিত। এর পাশাপাশি, গত ৪৮ ঘণ্টায় ৬০ জন নার্সও সংক্রমিত হয়েছেন। আমাদের ওয়ার্ডের ৬০টি শয্যায় ভর্তি ছিলেন বক্ষরোগে আক্রান্তেরা। কিন্তু তাঁদের রাতারাতি ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার ৩০ জন ও বুধবার আরও ২০ জনকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। অথচ, এঁদের অনেকের এখনও রোগ নির্ণয়ই হয়নি। কারও কারও ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার বা ‘প্রসিডিয়োর’-পরবর্তী সময়ে আরও কিছু দিন হাসপাতালে থাকা জরুরি ছিল। অনেকেই ভিন্ রাজ্য থেকে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। তাঁরাও এই আচমকা পরিবর্তনে হতভম্ব। সমাজের বৃহত্তর জনসংখ্যার স্বার্থে কিছু মানুষের কাছ থেকে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। কিন্তু আমরা নিরুপায়। অস্বাভাবিক একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি সবাই।
হাসপাতাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চারতলায় বক্ষরোগ বিভাগের গোটা ওয়ার্ড জুড়ে থাকবেন মহিলা কোভিড রোগীরা। ছ’তলার মেডিসিনের ওয়ার্ড বদলে যাচ্ছে কোভিডে আক্রান্ত পুরুষদের ওয়ার্ডে। বাকি ব্যবস্থা আগের বারের মতোই তৈরি হচ্ছে। আমাদের বক্ষরোগ বিভাগের প্রধান ম্যাডাম-সহ কয়েক জন প্রফেসরের উপসর্গ রয়েছে। অনেকেরই রিপোর্ট পজ়িটিভ আসছে। আমার বিভাগের চার জন ইন্টার্নের মধ্যে তিন জনই সংক্রমিত। অফিসে বসে করণিকের কাজ করেন যে দাদারা, তাঁদের কারও কারও উপসর্গই বলে দিচ্ছে, রিপোর্টে কী আসতে পারে। অনেকের এমনই অবস্থা, নেহাত পরীক্ষার জন্য সোয়াব দেওয়া হয়নি।
এই অবস্থায় রোগীর চাপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর আমাদের দল ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। এই ছোট দল নিয়েই বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘কোভিড ডিউটি’। ফলে আবার নতুন করে ‘রস্টার’ সাজানো শুরু হয়েছে। শূন্য থেকে শুরু হচ্ছে পুরনো লড়াই। আমার মতো যাঁদের কোনও উপসর্গ নেই, তাঁদের পজ়িটিভ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। আমাদের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে যাতায়াত― সবেতেই প্রতিকূলতা। হস্টেলে অনেকেই পজ়িটিভ। তাঁরা সেখানেই থাকছেন এবং খাওয়াদাওয়া করছেন। এই অবস্থায় আমার পক্ষে হস্টেলে থাকাটা ঝুঁকির। যদিও এ বার আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, এ যাত্রায় সংক্রমণমুক্ত থাকাটা সোনার পাথরবাটির মতো। তবু কয়েক জন আজ হস্টেলে খাইনি। কফি খেয়েছি আলাদা জায়গায়, খানিকটা আড়ালে। কাল কী করব, জানি না।
কাল সকালে গিয়ে দেখব নতুন করে মুঠো মুঠো হলুদ রং দিয়ে কোভিড পজ়িটিভ রিপোর্টের এক্সেল পেজটাকে। সেখানে নতুন নাম। সতীর্থ, পরিচিত, প্রফেসর, স্যর বা ম্যাডাম, ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ আর প্রচুর রোগী। অদ্ভুত একটা অনুভূতি আগেও হয়েছে। তবে এ বারের অভিজ্ঞতা সাংঘাতিক হতে চলেছে। সংক্রমণের চিকিৎসা করেও এত দিন নিজের সতর্কতায় তা থেকে মুক্ত থেকেছি। বুঝতে পারছি, এ বার আর কিছু হাতে নেই।
কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা? ভেবে দেখেছেন? মনে পড়ছে ২৫ ডিসেম্বর পার্ক স্ট্রিটের সেই ভিড় বা ৩১ ডিসেম্বর আর ১ জানুয়ারির ভিড়? যেখানে আপনিও সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিংবা ছোট সন্তানের হাত ধরে গিয়েছিলেন চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়ায় বর্ষশেষের মিঠে রোদ মেখে নিতে। সেখান থেকেই বিদ্যুতের গতিতে সংক্রমণ ছড়ানোর শুরু। যার ধাক্কায় রাজ্যে আছড়ে পড়েছে তৃতীয় ঢেউ। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে গবেষণা থেকে যা জানা গিয়েছে, তাতে এর উপসর্গ মৃদু। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে থেকেই এর চিকিৎসা সম্ভব। অযথা আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ভিড় বাড়াবেন না। কারণ, বয়স্ক বা কোমর্বিডিটি আছে, এমন রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ তাতে নষ্ট হবে। তবে সভ্যতার নিদর্শন না-রাখার এই ব্যর্থতা জনগণ ও প্রশাসন, উভয়েরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy