চলছে পথনাটিকা। রবিবার, ফিলিপস মোড়ের একটি পার্কে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
গরুর মুখোশ পরা ছ’-সাত জন মিলে এক জনকে মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। অসহায় সেই মানুষটি বাঁচার কাতর আর্জি জানিয়ে চলেছেন। কিন্তু গেরুয়া রঙের মালা গলানো সেই গরুরূপী মানুষদের হাত থেকে তাঁকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসছেন না। বরং ভিড় করে দেখে চলেছেন সে সব। রবিবার বিকেল ৪টে নাগাদ এমনই দৃশ্যের সাক্ষী থাকল সিআইটি রোডের ফিলিপস মোড়ের একটি পার্ক।
গল্প হলেও সত্যি এই ‘আজব দেশ কি গজব কাহানিয়া’।
এ দিনের এই পথ নাটিকায় দেখানো হল গোরক্ষক বাহিনীর হাতে দেশে কী ভাবে মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে ওঠা এমনই অভিযোগ বর্তমান সমাজের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির একটি। ধর্মের নামে কুসংস্কার-হানাহানি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশের মানুষের প্রতিবাদ, শিক্ষাঙ্গনে দুষ্কৃতীর তাণ্ডব— এমনই সব বিষয় এ দিনের একাধিক পথনাটিকায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে জানালেন এক নির্দেশক সৈকত ঘোষ।
সে সব নিয়েই রবিবার আয়োজন হয়েছিল এক নাগরিক কার্নিভালের। দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই পার্কে পথনাটিকা, গান-সহ নানা সৃষ্টিশীল মাধ্যমে প্রতিবাদ ফুটিয়ে তুললেন শিল্পীরা। অংশগ্রহণকারীরা জানালেন, ফ্যাসিজ়ম ক্রমশ গ্রাস করছে গোটা দেশকে। তার বিরুদ্ধেই তাঁদের এমন জোরালো প্রতিবাদ। এ দিনের কার্নিভালে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় দেড়শো শিল্পী। পার্কের ওই মাঠে কোনও মঞ্চ বাঁধা নেই। মাঠের ঘাসহীন মাটিতেই চলছিল একের পর এক পথনাটিকার প্রদর্শন। গোল করে সে সব দেখছিলেন দর্শকেরা। অভিজিৎ দাস নামে এক শিল্পী জানান, তাঁদের পথনাটিকাটি ধর্মের নামে বিভাজনের প্রতিবাদে। পাশাপাশি বাস করা ভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে কী ভাবে, কখন যেন পাঁচিল উঠে গেল। ফের কী ভাবে সেই পাঁচিল ধ্বংস হয়ে গেল তাও দেখানো হয়েছে ওই পথনাটিকায়। অভিজিতের কথায়, ‘‘ধর্মের নামে বিভাজন দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই এ সবের প্রতিবাদ তাই জরুরি।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল পড়ুয়া এসেছিলেন একটি পথনাটিকা নিয়ে। কৌশানী এবং সপ্তর্ষিদের মতে, এখনও অনেকে আছেন, যাঁরা মনে করেন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দুষ্কৃতীদের হানা তাঁদের প্রতিদিনের জীবনে স্পর্শ করবে না। এমন ভাবনা ভুল বলেই মনে করছেন কৌশানীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘ওঁদের জাগিয়ে তোলার জন্য, অর্থাৎ হঠাৎ বদলে যাওয়া সামাজিক পরিস্থিতি নিয়েই এই ভাবনা।’’ কিঙ্কিনী সেনগুপ্ত নামে অন্য এক শিল্পী জানালেন, দেশভাগের পর থেকে সন্ত্রাস কী ভাবে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে, তাঁদের নাটকের বিষয়বস্তু সেটাই।
পার্কের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন শিল্পীরা। এক দিকে যখন গোল করে কোনও দল পথনাটিকা প্রদর্শন করছেন, তখন অন্য দিকে হয়তো কেউ আবার পরবর্তী প্রদর্শনের জন্য মহড়া দিচ্ছেন। কেউ আবার গিটার বাজিয়ে প্রতিবাদের সুর বেঁধে গান করে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকটি স্টল বানিয়ে বিক্রি হচ্ছিল ফ্যাসিজ়মের বিরুদ্ধে টি-শার্ট-সহ বিভিন্ন উপকরণ। এক তরুণ বিক্রেতা বলেন, ‘‘আমরা চাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিরুদ্ধ মত হলেই তাঁকে চেপে ধরা হচ্ছে আজকাল। আরও সার্বিক প্রতিবাদ দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy