পাশে: ছেলে তোজোর সঙ্গে শ্রীমা। নিজস্ব চিত্র
তখন ওর বয়স বছর দুই। খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে হাবড়ায় হাড়ের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই ছেলেকে। ওকে দেখেই এমআরআই করতে বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। রিপোর্ট দেখে তিনি জানান, আমার ছেলে ঠিক স্বাভাবিক নয়। শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বাড়ি এসে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে বলেছিলাম সে কথা। কেউ বিশ্বাস করেননি। কিন্তু আমি করেছিলাম।
শুরু করেছিলাম নতুন লড়াই। হাবড়ার খাড়ো গ্রামে মা-বাবা আর তিন ভাই বোনের সঙ্গে থাকতাম। হাবড়ারই বাণীপুরের মিন্টু দাসের সঙ্গে ২০০৩ সালে আমার বিয়ে হয়। স্বামী তখন বাড়িতেই পাটের ব্যাগ তৈরি করতেন। ২০০৭ সালে ছেলে হয়। এ কাজ-ও কাজ করে অবশেষে গেঞ্জি কারখানায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন আমার স্বামী। ১১ বছর ধরে তাই করছেন। মাইনে সাত হাজার টাকার মতো। টিনের চালা আর ইটের দেওয়ালের মাঝের এই লড়াইটা আমার চেনা।
কিন্তু নতুন লড়াই একে বারেই অচেনা ছিল। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই তো মনে হচ্ছিল, তবু তোজো কেন স্বাভাবিক নয়, কী তার চিকিৎসা, তা জানতে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে একাই ছুটে গিয়েছি। শুনেছি, পুরো স্বাভাবিক ও কোনও দিন হতে পারবে না। তবে ভাল প্রশিক্ষণ পেলে উন্নতি হবে। কোথায় হয় সে সব? উত্তর পাইনি। শাশুড়ি বলেছিলেন, আমার বাড়ির দোষে ছেলেটা এমন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। কার দোষ বুঝি না। শুধু বুঝি, তোজোর জন্য শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাব।
তোজোকে স্কুলে ভর্তি করব বলেই তো ওর নাম দিয়েছিলাম সোহম। কিন্তু নর্মাল স্কুল ওর জন্য নয়, এ কথা বলে ভর্তি নেয়নি কয়েকটি স্কুল। অনেক ভেবে কুড়ি মিনিটের সাইকেলের দূরত্বে একটি নার্সারি স্কুলে দিয়েছিলাম। ক্লাসেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত। সে সব পরিষ্কার করার জন্য স্কুল থেকে ডাক পড়ত। এমনও হয়েছে, দিনে চার বার ছুটে গিয়েছি। এ জন্য রান্নাও হয়নি। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত খুব জেদ ছিল ছেলেটার। কিছু বায়না করে না পেলে রাস্তায় শুয়ে পড়ত, লোকের পা জড়িয়ে ধরত, মারধর করত।
এক ডাক্তারবাবুর থেকে জেনেছিলাম, পার্ক সার্কাসের শিশুদের হাসপাতালের সঙ্গে রয়েছে একটি স্কুল। ওদের মতো বাচ্চারাই সেখানে পড়ে। সাত মাস ধরে ওকে সেখানে নিয়ে যাই। ভোর ৫টায় উঠি। রান্না করে, স্নান সেরে সকাল ৯-১৩ মিনিটের বনগাঁ লোকালে শিয়ালদহ হয়ে পার্ক সার্কাস স্টেশনে নামি। বেশির ভাগ দিনই ছেলেটা ট্রেনে ঠিক মতো দাঁড়ানোরও জায়গা পায় না। স্টেশন থেকে কিছু ক্ষণ হেঁটে ১১টার মধ্যে ওকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিই। ৪টে পর্যন্ত বসে থাকি। সেই সময়ে কর্কের নীচে লেবেল লাগাই। প্রতি হাজার লেবেল লাগিয়ে ১৫ টাকা পাই। ফের বনগাঁ লোকাল ধরেই ওকে নিয়ে বাড়ি ঢুকি।
তোজোকে দুধ-মুড়ি খেতে দিয়ে তবলায় বসিয়ে দিই। রাতের রুটি করতে করতে তবলার বোল তোলাই। উৎসাহ আছে দেখে পাঁচশো টাকা দিয়ে এক বছর মাস্টার রেখেছি। ম্যাডামেরা যে ভাবে দেখিয়ে দেন, সে ভাবে ওকে পড়াই। স্কুলে ওদের বিহেভিয়োরাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপিও হয়। এখন তোজো ছড়া বলতে পারে, ভাল নাচ করতে পারে, কোনও কথা বললে বুঝে উত্তর দিতে পারে। আগের থেকে অনেক শান্ত হয়েছে। মার খেলেও আর মারে না। নতুন বন্ধুদের ভালবাসে। যে কোনও জিনিস ভাগ করে নেয়।
তোজোকে আত্মনির্ভরশীল হতে দেখতে চাই। এ জন্য পুরো লড়াইটা একাই করছি, করেও যাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy