স্ত্রী সুদীপার সঙ্গে অরুণাভ রায়, মেয়ের সঙ্গে সুষমা রায় মজুমদার, স্বামী তরুণ মেটের সঙ্গে সীমা মেটে। নিজস্ব চিত্র।
প্রায় নিঃশব্দেই মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে গেল আরও একটি ‘বিশ্ব অ্যালঝাইমার’স সচেতনতা দিবস’। যদিও এক দিন নয়, প্রতিদিনের সচেতনতাই কিছুটা আটকাতে পারে এই রোগের প্রকোপ। তাই অবহেলা নয়, ছোট ছোট উপসর্গকেও।
থমকে স্টিয়ারিং: কল সারাই থেকে জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার, বাড়ির যাবতীয় কাজ করতেন ছিপছিপে মানুষটি। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গতি তোলাই ছিল যাঁর আনন্দ, তাঁর জীবন এখন আটকে বিছানায়। হাঁটা তো দূর, অনেক কষ্টে চেয়ারে বসানো যায়। এক সময়ের উজ্জ্বল দৃষ্টি এখন প্রায় ক্ষীণ। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। শুধু টেবিল চাপড়ে কিছু বলতে চান সিইএসসি-র বজবজ প্লান্টের প্রাক্তন ডেপুটি ম্যানেজার, বছর ৬২-র অরুণাভ রায়। নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু অক্সিজেন জোগায় শুধু গান শোনা। পিছিয়ে যাওয়া যাক পাঁচ বছর, ২০১৬-য়। অফিস থেকে গড়িয়ার বাড়িতে ফেরার পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার শুরু। স্ত্রী, পেশায় কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের কর্মী সুদীপা রায় (মজুমদার) জানাচ্ছেন, বিভিন্ন জনের থেকে খবর পেয়ে নিয়ে আসতেন স্বামীকে। কখনও প্লান্টের ছাইয়ের গাদায় উঠে যেতেন, কখনও রেললাইনে দাঁড়িয়ে পড়তেন। চিকিৎসায় ধরা পড়ে, অ্যালঝাইমার’স-এর অ্যাডভান্সড স্টেজ। গত বছর লকডাউনে সমস্যা বাড়ে। বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সবার অলক্ষ্যে বাড়ির পাঁচিলে উঠে টপকাতে যান অরুণাভ। পড়ে গিয়ে ডান পায়ের হাড় ভাঙেন। অস্ত্রোপচার হয়। ঠিক তার পরপরই হানা দেয় কোভিড। সংক্রমণে মস্তিষ্ক প্রায় পুরোই নষ্ট হয়েছে। বিধ্বস্ত সুদীপাকে সব সামলে ছুটতে হয় কর্মস্থল নিজাম প্যালেসে। এরই মধ্যে দফতর থেকে বদলির চাপ আসছে। দম্পতির একমাত্র মেয়ে ভুবনেশ্বরে ডাক্তারি পড়ছেন। স্ত্রী-মেয়েকে চিনতে পারেন না অরুণাভ। কান্নাভেজা গলায় সুদীপা বলছেন, ‘‘ওঁকে নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাব।’’
অবসন্ন মন: ২০১৫ সালে স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি সুষমা রায় মজুমদার। একমাত্র ভরসা বলতে তাঁর মেয়ে ঈপ্সিতা। ব্যবসার কাজে ব্যস্ততা সত্ত্বেও মাকে সঙ্গ দিতেন মেয়ে। তবু, একাকিত্ব গ্রাস করে সুষমাকে। ২০১৬ নাগাদ ঘন ঘন সংজ্ঞাহীন হতেন। ধরা পড়ে ব্রেন ইস্কিমিয়া। এর কিছু দিন পরে সামনে আসে ভুলে যাওয়ার সমস্যা। জলখাবার খেয়েই ভুলে গেলেন, কী খেলেন। চিকিৎসক জানালেন, অবসাদ ও বার্ধক্যের কারণে ডিমেনশিয়া। ফের নতুন সমস্যা। কথাবার্তা কমে যাওয়া, বললেও তা অসংলগ্ন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ডাক্তারেরা জানালেন, সুষমা অ্যালঝাইমার’স-এ আক্রান্ত। শুরু হল চিকিৎসা। বাড়তে থাকল সন্তানকে চোখে হারানোর আতঙ্ক, বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, খাবার খেয়ে ভুলে যাওয়া। অগত্যা ওষুধ বদল। ঈপ্সিতা জানালেন, কিছু আচরণে বদল এলেও প্রচণ্ড রাগ, স্নান করতে না চাওয়া, ঘরের যত্রতত্র শৌচকর্ম করে ফেলার মতো আচরণ বাড়ছিল। এখন সারা দিন ঠাকুরের গান আর মন্ত্র পড়ে যান বছর ৭০-এর সুষমা। গত তিন মাসে দু’বার ব্রেন স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। কোভিড হওয়ায় এখন বৃদ্ধা ভর্তি এম আর বাঙুর হাসপাতালে। ঈপ্সিতা নিজেও কোভিডে আক্রান্ত। ব্যবসা আর মাকে সামলে ক্লান্ত মেয়ে বলেন, “আগে দ্রুত উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। এখন বুঝি, মানুষটা তো নিজেকে হারিয়েই ফেলেছেন। তাঁকে সামলাতে হবে আমাকেই। জানি, খুব কঠিন সে কাজ। তবু চেষ্টা করে চলেছি।”
অক্ষরহীন জীবন: পেশা সাইনবোর্ড লেখা। মাসিক আয় খুব বেশি হলে দশ হাজার টাকা। তবুও স্ত্রীর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ মেটে। স্ত্রী, ৪২-এর সীমা অ্যালঝাইমার’স-এ আক্রান্ত। সমস্যা ধরা পড়েছিল ৩৬ বছর বয়সে। চায়ে চিনি দিতে ভুলে যাওয়া, গ্যাস বন্ধ করতে ভুলে যাওয়া দিয়ে শুরু। এর পরে ঘরের সুইচ খুঁজে না পাওয়া, খাবার থালা এক দিকে তো সীমা বসছেন অন্য দিকে। ক্রমেই বাড়তে থাকে সমস্যা। শেষে সরকারি হাসপাতালে ধরা পড়ে অ্যালঝাইমার’স। ছেলেকে অক্ষরজ্ঞান দেওয়া মা নিজেই এখন ভুলেছেন সব। সইটুকুও করতে পারেন না। কথা বলেন খুব কম। স্নান করানো, জামা পরিয়ে দেওয়া— সব করেন তরুণ। তবে শৈশবে পড়া কবিতা গড়গড়িয়ে বলেন সীমা। ছোটবেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। এত বছর পরে ফের সে সব গান করেন। আজকাল মা-ভাইকে চিনতে পারছেন না। এখনও চেনেন স্বামী আর সদ্য স্নাতক ছেলেকে। মাঝেমধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে একরাশ অভিমান ঝরে পড়ে। তরুণ বলছেন, “মাসে ওষুধ লাগে তিন হাজার টাকার। লকডাউনে কাজ ছিল না। ধার করে ওষুধ খাইয়েছি। এ ভাবেই টেনে চলেছি। প্রতিদিনই ভাবি, কাল কী হবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy