অস্ত্রোপচারের পরে ভবতোষ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
আট ঘণ্টা ধরে ১২ জন চিকিৎসকের টানা লড়াইয়ের পরে মিলেছে সাফল্য। কানের ভিতরের ক্যানসার প্রায় মস্তিষ্কের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এক প্রৌঢ়ের অস্ত্রোপচার করে তাঁকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে দিল এসএসকেএম হাসপাতাল।
রানাঘাটের বাসিন্দা, পেশায় কৃষক ভবতোষ মণ্ডল বছর তিনেক ধরে মাথা ও বাঁ কানের যন্ত্রণার সমস্যায় ভুগছিলেন। এক সময় কান থেকে পুঁজ-রক্তও বেরোতে শুরু করে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও সুরাহা হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে শহরের এক হাসপাতালে ভবতোষের কানে অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু তার পরেও একই ভাবে রক্তপাত ও যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি। বরং ক্রমশ মুখের বিকৃতি ঘটতে শুরু করে। বছর পঞ্চাশের ভবতোষের ভাই গৌতমের কথায়, ‘‘ছয় মাস পরে আবার অস্ত্রোপচার করা হবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু দাদার কষ্ট ক্রমশ বাড়ছিল। এ দিকে লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিছুই করা যাচ্ছিল না।’’ এর পরে মাসখানেক আগে তাঁরা এসএসকেএম হাসপাতালের শিক্ষক চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তের কাছে যান।
অরুণাভবাবু বলেন, ‘‘সমস্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই ব্যক্তির কানের ভিতরের ক্যানসার প্রায় মস্তিষ্কের কাছাকাছি পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তখনই আমরা অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিই।’’ সেইমতো এসএসকেএম হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয় ওই রোগীকে। তবে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা খুব সহজসাধ্য ছিল না। বেশ জটিল এবং বিরল ওই অস্ত্রোপচারের জন্য নাক-কান-গলা, হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি ও অ্যানেস্থেশিয়া মিলিয়ে ১২ জন চিকিৎসকের একটি দল তৈরি হয়। অরুণাভবাবুর নেতৃত্বে ওই দলে ছিলেন চিকিৎসক অরিন্দম দাস, হর্ষ ধর, অনিমেশ ঘোষ, সন্দীপ্তা মিত্র, মৃদুল জানবেজা-সহ অন্যরা।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ‘সাবটোটাল টেম্পোরাল বোন রিসেকশন’ (এসটিবিআর)—এই অস্ত্রোপচারটিকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথমে ভবতোষের বাঁ কানের হাড় পুরো কেটে বের করে ফেলা হয়। তার পরে ভিতরের প্যারোটিড গ্রন্থি কেটে বাদ দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ওই কানের ঠিক নীচে, গলার কিছুটা অংশ কেটে ভিতরের নোডগুলিকে পরিষ্কার করা হয়। চতুর্থ পর্যায়ে কানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া মুখের স্নায়ুর (ফেসিয়াল নার্ভ) যে অংশে ক্যানসার ছড়িয়েছিল সেটি কেটে বাদ দিয়ে, শরীরের অন্য জায়গা থেকে স্নায়ু কেটে সেখানে জুড়ে দেওয়া হয়। একেবারে শেষে বুকের উপর থেকে মাংস কেটে কানের ওই অংশের গর্তটি ভরাট করা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, মুখের স্নায়ু ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ফলেই ভবতোষের মুখ বেঁকে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘কানের উপরে টিউমার হলে সেটা দেখা যায়। কিন্তু ভিতরে ক্যানসার ছড়িয়েছে এমন সচরাচর দেখা যায় না। ঠিক সময়ে অস্ত্রোপচার না হলে পুরো মস্তিষ্কেও ক্যানসার ছড়ানোর সম্ভাবনা ছিল।’’
গত ৩ মার্চ এসএসকেএম হাসপাতালে ইনস্টিটিউট অব ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি বিভাগের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। ওই বিভাগে রয়েছে ১৮০টি শয্যা। এ ছাড়াও ২৪ ঘণ্টার জরুরি পরিষেবাও চালু করা হয়েছে। শিশুদের ব্রঙ্কোস্কোপি-সহ মস্তিস্কের জটিল অস্ত্রোপচারও ওই বিভাগে হচ্ছে বলেই জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেমনটা হয়েছে ভবতোষের। গত ২৮ নভেম্বর তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, রেডিয়োথেরাপি নিতে আরও এক বার তাঁকে হাসপাতালে আসতে হবে।
তবে রানাঘাটের বাড়িতে ফিরে বেজায় খুশি ভবতোষ। তাঁর স্ত্রী অসীমা মণ্ডল বলেন, ‘‘কী হবে ভেবেই ভয় হত। পিজির চিকিৎসকেরা আমার স্বামীকে আবার সুস্থ করে তুলেছেন।’’ হাসপাতালে তরল খাবার চললেও বাড়ি ফিরে এখন পছন্দের ভাত-মাছের ঝোল নিজের হাতেই মুখে তুলছেন ভবতোষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy