ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দু’টো ছুঁই ছুঁই। মেটিয়াবুরুজে মুদিয়ালি রোডের আমিনা মার্কেটের অফিসে বসে একের পর এক দরখাস্তে সই করে চলেছেন কলকাতা পুরভার মেয়র পারিষদ (তথ্য ও সংস্কৃতি) তথা আনসারি পরিবারের বড়কর্তা সামসুজ্জামান আনসারি। গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজে এখনও আনসারি পরিবারের দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায় বলে কানাঘুষো রয়েছে।
কিন্তু এ বারের পুর-নির্বাচনে আনসারি পরিবারের ঘরোয়া কোন্দল বাইরে চলে এসেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে আম-আদমি। বন্দর এলাকার ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে বরো ১৫। সব ওয়ার্ডে কান পাতলে একটাই আলোচনা, আনসারি পরিবারের সদস্যেরা এ বার একে অপরকে শায়েস্তা করতে রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছেন। ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে আনসারি পরিবারের চার সদস্য সরাসরি যুদ্ধে নেমেছেন। সামসুজ্জামানের দুই ভাই আমিন আনসারি ওরফে ঝুন্নু ও রহমত আলম আনসারি। আর এক ভাইপো ওয়াসিম। ১৩৭ থেকে তিন বার সিপিএম প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন আমিন আনসারি ওরফে ঝুন্নু। এ বার সিপিএম ছেড়ে তিনি তৃণমূল প্রার্থী। আর এক ভাই রহমত নির্দল প্রার্থী। আর ভাইপো ওয়াসিম জাতীয় কংগ্রসের তরফে ওই ওয়ার্ডে লড়াই করছেন।
আনাসারি পরিবারের বড়কর্তার অফিসে নিজের পরিচয় দিয়ে সামনে দাঁড়াতেই নানা দরখাস্তে সইয়ের ফাঁকে মুখ তুলে পাশের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। সবটাই চোখের ইশারায়। আরও কিছু সইয়ের পরে সামসুজ্জামান তাকালেন। জি়জ্ঞেস করলেন, ‘‘চা খাবেন তো?’’ বললাম, ‘একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন ছিল।’ চশমাটা খুলে, চোখে চোখ রেখে সামসুজ্জামানের বক্তব্য, ‘‘একটা নয়, দুটো অস্বস্তিকর প্রশ্ন করবেন আপনি। তা আমি জানি।’’ ১৩৭ ও ১৩৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে দু’টি প্রশ্ন। ‘‘ঠিক বলছি তো?’’ নিজেই প্রশ্ন তুলে উত্তর শুরু করলেন সামসুজ্জামান। বললেন, ‘‘ওখানে (১৩৭ নম্বর ওয়ার্ড) আমার পরিবারের যাঁরা লড়াই করছেন, তাঁরা আমায় কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আমার কোনও অনুমতি নেননি। নিজেরাই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমিও নিষেধ করিনি। সকলেই মনে হচ্ছে নিজেদের ইচ্ছাপূরণ করছেন। আমি বাধা দিচ্ছি না। এর বেশি কিছু বলব না।’’
আর একটি প্রশ্নের প্রেক্ষিত হল, গত পুর-নির্বাচনে ১৩৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সিপিএমের দাপুটে প্রার্থী বিজলি সেনকে হারিয়েছিলেন সামসুজ্জামান। বন্দর এলাকার ওই সময়ের দাপুটে সিপিএম নেতা দিলীপ সেনের স্ত্রী বিজলি। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামী সামসুজ্জামানের হাত ধরেই ওই ওয়ার্ড সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। বন্দর এলাকার তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, সিপিএমের কাছ থেকে ওই ওয়ার্ড ছিনিয়ে নেওয়ার পুরস্কারও মিলেছিল সামনুজ্জামানের, তাঁকে মেয়র পারিষদ করা হয়েছিল।
এ বার সিপিএম ওই এলাকায় পায়ের তলায় মাটি হারিয়েছে। কিন্তু সামসুজ্জামান আনসারির জয়ের পথ মসৃণ হয়নি। উল্টে আরও কঠিন লড়াইয়ে পড়ে গিয়েছেন। বিজলি সেন তো আছেনই। তার পরে গোদের উপরে বিষ ফোঁড়া, তার ‘বেয়াই’ কংগ্রেস নেতা ও বন্দর এলাকার ডন মোক্তার আহমেদ। বছর চারেক আগে সামসুজ্জামান আনসারির ছেলে ইমরানের সঙ্গে মোক্তারে মেয়ে সানার বিয়ে হয়েছে। ওই এলাকায় ক্ষমতায় কোনও ভাবেই আনসারি পরিবারের থেকে কম নন মোক্তার। বিজলি ও মোক্তারকে নিয়ে এ বার তিনি কিছুটা চিন্তায় রয়েছেন, তা পরোক্ষে বলেই ফেললেন সামসুজ্জামান। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেয়র পারিষদ বলেন, ‘‘দলের ছেলেরা বলছে আমি জিতব। আমি এলাকায় উন্নয়নও করেছি। কিন্তু ছেলেদের কথা সবটা বিশ্বাস করি না। মানুষ যদি ভোট দেয়, তা হলে জিতব। দেখলেন না, দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে কী হল! সকলে বলেছিল বিজেপি জিতবে। শেষে মানুষের ভোটে আম-আদমির পার্টি জিতল। মানুষের উপরে সব নির্ভর করছে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই।’’
নিজের ওয়ার্ড নিয়ে চিন্তিত হলেও ১৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর পুত্রবধূ রুবিনা নাজের জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত বলে জানালেন সামসুজ্জামান। গত লোকসভার ভোটের নিরিখে তাঁর পুত্রবধূ ওই ওয়ার্ডে প্রায় তিন হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। এ বার পরিস্থিতি আরও ভাল বলে জানালেন সামসুজ্জামান। মেয়র পারিষদের চারটে বাড়ির পরেই মোক্তারের অফিস। ভর দুপুরে অফিসে বসে টিভিতে খবর দেখছেন মোক্তার। সম্পর্কে ‘বেয়াই’ সামসুজ্জামানকে মানুষই হারাবে বলে মন্তব্য করলেন তিনি। মোক্তারের ব্যাখা, ওই ওয়ার্ডে আনসারি পরিবার নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কাজ করেনি। মানুষকে ধোকা দিয়েছে ওরা। নানা সময়ে মারধর করেছে। মানুষ আনসারি পরিবারের উপরে ক্ষিপ্ত। সেই কারণেই এ বার ওরা আর জিতবে না। আনসারি পরিবারকে শিক্ষা দিতেই আমাকে জেতাবে মানুষ।’’
কিন্তু বেয়াই সামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে লড়তে এলেন কেন? এই প্রশ্নের জবাবে মোক্তার বলেন, ‘‘সামসুজ্জামানের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আত্মীয়তা আর রাজনীতি এক নয়। আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। সে ক্ষেত্রে আত্মীয়তা গুরুত্বহীন বলে মনে করি।’’ তবে কংগ্রেস নেতা মোক্তার আহমেদের লড়াই মুদিয়ালি রোড এলাকায় আনাসারি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মুদিয়ালি রোড পেরিয়ে আধ কিমি এগোলেই আয়রন গেট রোডের বাসিন্দা, বন্দরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অনুগামী ১৫ নম্বর বরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান মুন্না ইকবালের এলাকাতেও রীতিমতো টক্কর দিতে হবে মোক্তারকে।
বছর দুয়েক আগে হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সংঘর্ষে এক পুলিশকর্মী খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত ফিরহাদ অনুগামী ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুন্নাকে এ বার প্রার্থী করেনি তৃণমূল। মুন্নার ছেলে সামস ইকবাল ওরফে অনিল প্রার্থী হয়েছেন। মোক্তারের কথায়, ‘‘বুথ দখল ছাড়া মুন্নাভাইরা ভোটে জিততে পারবে না। ওরা আনসারিদের মতোই এলাকার মানুষদের উপরে অত্যাচার করে। ওখানেও মানুষ ক্ষিপ্ত।’’ কিন্তু ভোটের দিন কী ভাবে হবে বুথ দখল? রিমোট দিয়ে টিভির আওয়াজ মিউট করে মোক্তার চাপা সুরে বলেন, ‘‘ওরা শুরু করলে, আমরাও কিন্তু চুপ করে বসে থাকব না। আমরাও ম্যাচ খেলতে জানি। তবে ওদের সঙ্গে পুলিশ আছে। যা আমাদের সঙ্গে নেই। এটাই একটা তফাত করে দিতে পারে।’’ তবে বুথ দখলের কোনও প্রশ্ন নেই বলে মোক্তারের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন মুন্নাপুত্র অনিল। ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের আলিফনগর এলাকায় এক দলীয় অফিসে বসে অনিল বলেন, ‘‘বুথ দখল মোক্তারেরা করেন। ওঁরা গুন্ডা। আমরা সারা বছর মানুষের বিপদে-আপদে থাকি। এলাকায় পানীয় জল-নিকাশি উন্নয়ন করেছি। মানুষ আমাদের কাজ দেখে ভোট দেবে। বুথ দখল করতে হবে না। লোকসভা নির্বাচনের নিরিক্ষে ১৩৪ নম্বরে তৃণমূল প্রায় চার হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে। তা বুথ দখল করে হয়নি। ওরাই বুথ দখল করার চেষ্টা করবে। আর আমাদের উপরে দোষ চাপাবে।’’
১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী বরো চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীলের কথায়, লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূল সাতটি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে। শুধু ১৩৯ ও ১৪০ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম এগিয়ে রয়েছে। এ বার ৯টি ওয়ার্ডই তৃণমূলের দখলে আসবে। লোকসভার নিরিখে ব্যাকফুটে থাকলেও সিপিএম আশাবাদী। কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দিলীপ সেন বলেন, ‘‘তৃণমূল আর কংগ্রেস ভাই-ভাই। মানুষ তা বুঝে গিয়েছে। পরিবর্তনের ফল টের পাচ্ছেন। দুর্নীতি আর প্রতিশ্রুতি। আর সব ফাঁকা। নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে আমরা মানুষের সাড়া পাচ্ছি। তৃণমূল ও কংগ্রেসের উপরে আস্থা হারিয়েছে মানুষ। সিপিএম বরো দখল করে নিলে আমি অবাক হব না।’’ লোকসভা নির্বাচনের নিরিক্ষে বরো ১৫ এলাকার একমাত্র ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে ছিল। বাকি সব ওয়ার্ডে তিন নম্বরে। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তথা রাজ্য বিজেপি নেতা অভিজিৎ দাস (ববি) বলেন, ‘‘কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম ভোটের পরে বুঝতে পারবে। বিজেপি কত নম্বরে থাকে। তিনটি দলই যে দুর্নীতিগ্রস্ত, তা মানুষ বুঝে গিয়েছে। মানুষ বিজেপিকেই ভোট দেবে।’’ বন্দর এলাকায় আনসারি পরিবার শোভন চট্টোপাধ্যায় অনুগামী আর মুন্না ইকবাল ফিরহাদ গোষ্ঠীর। এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘নির্বাচনে তৃণমূলের অন্দরে ওই দুই গোষ্ঠীর প্রভাব পড়বে না। লড়াই হবে ত্রিমুখী। তৃণমূল-সিপিএম ও কংগ্রেস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy