Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ছক ভাঙা তৃতীয় স্বরকে চেনার ক্লাস

জয়িতা মণ্ডল ওরফে জয়ন্ত, বা শ্রেয়া কর্মকার ওরফে সম্রাটের সামনে এক দশক আগের স্কুলজীবনের সব মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছিল শনিবার দুপুরে। নিজের লিঙ্গসত্তা নিয়ে বিচিত্র টানাপড়েন পার করে জয়িতা এখন ইসলামপুরে লোক আদালতের বিচারক। আর সফল মডেল শ্রেয়া কাজের টানে দিল্লি-মুম্বই করে বেড়াচ্ছেন।

পড়ুয়াদের সঙ্গে শ্রেয়া এবং জয়িতা। শনিবার।  ছবি: সুমন বল্লভ

পড়ুয়াদের সঙ্গে শ্রেয়া এবং জয়িতা। শনিবার।  ছবি: সুমন বল্লভ

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৫৭
Share: Save:

স্কুলের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা ঠিক আর পাঁচ জন ছাত্রের মতো ছিল না কখনও। আকছার সহপাঠীদের কাছে টিটকিরি শুনতে হয়েছে, কখনও বা লম্বা চুল রাখার জন্য স্যর বা ম্যাডামদের কাছে জুটেছে বকুনি।

আবার এই স্কুলেই ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতার নারীবেশের জন্য কোনও শিক্ষক বাড়ি থেকে শাড়ি-গয়না এনে দিয়েছেন। কিংবা অন্য ছেলেদের সামনে সে লজ্জা পাচ্ছে দেখে দিদিমণিরা নিজেদের শৌচাগার ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন সেই ‘ছাত্র’টিকে।

জয়িতা মণ্ডল ওরফে জয়ন্ত, বা শ্রেয়া কর্মকার ওরফে সম্রাটের সামনে এক দশক আগের স্কুলজীবনের সব মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছিল শনিবার দুপুরে। নিজের লিঙ্গসত্তা নিয়ে বিচিত্র টানাপড়েন পার করে জয়িতা এখন ইসলামপুরে লোক আদালতের বিচারক। আর সফল মডেল শ্রেয়া কাজের টানে দিল্লি-মুম্বই করে বেড়াচ্ছেন। স্কুলের ‘গর্বের মুখ’ ওই দুই কৃতীর উজান ঠেলা লড়াইয়ের গল্প শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যাচ্ছিল দক্ষিণ শহরতলির একটি স্কুল। নেতাজিনগর বিদ্যামন্দিরের একাদশ শ্রেণির রোহিত নস্কর উঠে দাঁড়িয়ে অকুণ্ঠ স্বরে বলে উঠল, ‘‘এখনও ক্লাসের কোনও কোনও বন্ধুর হাবভাব দেখে ঠাট্টা করে আমরা কিছু ভুলভাল কথা বলে ফেলি ঠিকই! খেয়াল রাখব, আর কখনও এমন যেন না হয়!’’

সরকারপোষিত বাংলামাধ্যম এই স্কুলের মতো রাজ্যের বেশিরভাগ স্কুলেই তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত রূপান্তরকামী, হিজড়েদের নিয়ে ভুল ধারণার ছড়াছড়ি। নিজেদের লিঙ্গবোধ বা যৌন চেতনার বিষয়টিতেও রয়েছে নানা ধোঁয়াশা। স্কুলেরই এক প্রাক্তন ছাত্র, অধুনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলের স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া শোভন মুখোপাধ্যায়কে সামনে রেখে এই চোখ মেলার কাজটা কয়েক কদম এগোল। বছরখানেক আগে একার চেষ্টায় এ শহরে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের জন্য ‘ত্রিধারা’ স্টিকার বসানো শৌচালয় গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন শোভন। সেই কাজের জন্য সর্বভারতীয় একটি পুরস্কারের সামান্য টাকা কাজে লাগিয়ে নিজের স্কুল থেকেই তিনি শুরু করলেন তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ।

শোভনের পরিকল্পনায় ‘ত্রিবন্ধন উৎসবে’ মানসিক জড়তা ভেঙে এগিয়েও এসেছেন বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহকর্মী মানস গঙ্গোপাধ্যায়, সুজাতা মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস বেরারা বলছিলেন, ‘‘ছাত্রেরা সকলেই গড়পড়তা ছেলের মতো নয়। ধাপে ধাপে নানা অভিজ্ঞতায় বহু পড়ুয়ার মনটা বুঝতে শিখেছি আমরা।’’ শিশু সুরক্ষা অধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তীও শোনালেন, ছোটবেলার অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘সাউথ পয়েন্ট স্কুলে আমাদের সময়ের ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের (পরবর্তীকালের চিত্র পরিচালক) হাবভাব নিয়েও অনেকে হাসাহাসি করেছি। ক্রমশ বুঝতে পেরেছি, তখন কাজটা ঠিক হয়নি।’’

যৌনতার বোধ বা লিঙ্গের নিরিখে গড়পড়তা ছাত্রছাত্রীদের থেকে আলাদা পড়ুয়াদের জন্য স্কুলে স্কুলে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরির কাজে এখনও বিস্তর ফাঁক রয়েছে। নানা ক্ষেত্রে সফল এক ঝাঁক রূপান্তরকামী পুরুষ-মহিলার উপস্থিতি নেতাজিনগরের স্কুলে সেই চেতনার গোড়া ধরেই টান দিয়ে গেল। হাতের পাঁচটা আঙুলের মতো সব ছেলে বা মেয়েও এক রকম হয় না। সবার মধ্যেই মিশে থাকে এক ধরনের অর্ধনারীশ্বর সত্তা। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে স্কুলের পড়ুয়ারা বারবার হাততালি দিয়েছে।

শোভন বললেন, ‘‘স্কুলের গ্রন্থাগারেও তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়ে সচেতনতার কিছু বইয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’ ঝাঁকে ঝাঁকে নবম, দশম, একাদশের পড়ুয়ারা এসে তখন নিজস্বীর আবদার করেছে তাদের শ্রেয়াদি, জয়িতাদির কাছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Class Transgender School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy