চলে যেতে পারেন তিনি, এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। চলেই যাচ্ছেন জেনে বৃহস্পতিবার রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
প্রেসিডেন্সি ছেড়ে দিচ্ছেন সোমক রায়চৌধুরী। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান তথা ভর্তি কমিটির চেয়ারম্যান। উপাচার্যের পরে কার্যত তিনিই। বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে তিনি গুরুদায়িত্ব সামলে এসেছেন। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সেই সোমকবাবুই চলে যাচ্ছেন। ‘লিয়েন’ নিয়ে যোগ দিচ্ছেন পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা কেন্দ্র) বা (আইইউকা)-এর অধিকর্তা-পদে।
সোমকবাবুর এই সম্মানে শিক্ষা শিবির উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তাঁর মতো এক শিক্ষক-গবেষক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পড়ুয়াদের একাংশ হতাশ। যদিও উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া এ দিন বলেন, ‘‘সোমকের শূন্যস্থান অপূরণীয় ঠিকই। তবে কেউ অপরিহার্য নন। প্রেসিডেন্সি প্রেসিডেন্সির মতোই চলবে। সোমক ওখানে যাওয়ায় আমি খুশি। এটা খুবই গর্বের বিষয়।’’
সোমকবাবু এ দিন বলেন, ‘‘কবে যাব, ঠিক করিনি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেও কোনও নথি জমা দিইনি।’’ যদিও তাঁকে পাশে বসিয়েই উপাচার্য এ দিন জানিয়ে দেন, সোমকবাবু প্রথমে এক বছরের লিয়েন নিয়ে পুণের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকর্তা-পদে যোগ দিতে চলেছেন। পরে লিয়েনের মেয়াদ বেড়ে পাঁচ বছরও হতে পারে। তবে সোমকবাবু মানসিক ভাবে প্রেসিডেন্সির সঙ্গেই থাকবেন বলে আশা করেন উপাচার্য।
ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারছেন না। একের পর এক শিক্ষক, এমনকী বিভাগীয় প্রধান প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাঁরা উদ্বিগ্ন। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রধানকে ছাড়াই কোনও মতে চলছে ক্লাস। এ বার পদার্থবিদ্যার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের প্রধান পদ শূন্য হতে চলেছে। এর আগে পদার্থবিদ্যা বিভাগেরই চেয়ার প্রফেসর (আচার্য জগদীশ বসু অধ্যাপক) সব্যসাচী ভট্টাচার্য প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। পদত্যাগের আগে ওখানকার শিক্ষার পরিবেশ এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। অভিযোগ তুলেছিলেন, প্রেসিডেন্সিতে তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। তারই জেরে নিজের পুরনো কর্মক্ষেত্র টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে ফিরে যান সব্যসাচীবাবু।
সোমকবাবু অবশ্য সব্যসাচীবাবুর মতো কোনও ক্ষোভ বা খেদ থেকে প্রেসিডেন্সি ছাড়ছেন না। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা গবেষণায় আইইউকা-কে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বলেই গণ্য করে শিক্ষাজগৎ। সেখানকার কর্ণধারের পদ খুবই গরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত সম্মানের বলেই শিক্ষকদের অভিমত। কিন্তু তাঁরা এটাও স্বীকার করছেন যে, অন্যান্য শিক্ষক ছাড়াও সব্যসাচীবাবু-সোমকবাবুর মতো অধ্যাপকদের পরপর চলে যাওয়ার ধাক্কা প্রেসিডেন্সিতে লাগবেই।
শিক্ষকেরা ক্রমশ প্রেসিডেন্সির মতো নামী প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিমুখ হয়ে উঠছেন কেন, সেই প্রশ্ন উঠছেই। বিভিন্ন শিক্ষক ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার আগে ব্যক্তিগত কারণের উল্লেখ করেছেন। পারিশ্রমিক কম বলে অনুযোগ করেছেন। বলেছেন গবেষণার পরিকাঠামোর অভাবের কথাও। প্রেসিডেন্সির এক শিক্ষক এ দিন জানান, বিদেশের তো বটেই, এ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তুলনায় প্রেসিডেন্সির বেতন এত কম যে, ভাল শিক্ষকদের এখানে রাখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক প্রেসিডেন্সির তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি বেতন পান। সেখানে পড়ানোর সুযোগ পেলে কোনও শিক্ষক প্রেসিডেন্সিতে পড়ে থাকবেন কেন, প্রশ্ন ওই শিক্ষকের।
অথচ প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ব মানের প্রতিষ্ঠান করে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। গড়া হয়েছিল মেন্টর গ্রুপ। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়া এক শিক্ষকের মন্তব্য, ‘‘প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় করা গেলে এখান থেকে শিক্ষকদের চলে যাওয়া ঠেকানো যেত। গবেষণা এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য পাওয়া যেত প্রচুর অর্থ।’’ সেটা হল না কেন? ওই শিক্ষক বলেন, ‘‘ইউপিএ জমানায় প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তাতে রাজি হয়নি। সে-দিন রাজি হলে প্রেসিডেন্সির এই হাল হত না।’’
সব্যসাচীবাবুর প্রেসিডেন্সি-ত্যাগের ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়টির যে বড় ভূমিকা ছিল, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর তা স্বীকার করে নিয়েছে। ওই দফতরের অধিকাংশ অফিসারের অভিমত, সোমকবাবুর পুণে চলে যাওয়ার কারণও তা-ই। এতে অবশ্য দোষের কিছু দেখছেন না তাঁরা। উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, পুণেতে সোমকবাবুর পদটি উপাচার্যের তুল্যমূল্য। সেখানে তিনি যা বেতন পাবেন, সেটা প্রেসিডেন্সির উপাচার্যের বেতনের থেকেও বেশি।
সোমকবাবু নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘পুণেতে কত বেতন পাব, আমি মোটেই তার ধার ধারি না। যখন আমি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে প্রেসিডেন্সিতে এসেছিলাম, তখন আমার বেতন সাত গুণ কমে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এখানে কাজ করেছি।’’ তিনি জানিয়ে দেন, বেতন নয়, পুণের ওই পদ (অধিকর্তা) তাঁর কাছে অনেক বেশি সম্মানের।
‘‘যেখানেই থাকি, প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের গবেষণার কাজে আমি সহযোগিতা করব,’’ আশ্বাস দিয়েছেন সোমকবাবু। শিক্ষক-ঘাটতিতে ভুগতে থাকা প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের সান্ত্বনা বলতে আপাতত এটুকুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy