শাসক দলের বছরকার সমাবেশের দিন শহরের রাস্তায় বাস-ট্যাক্সি তেমন ছিল না। ফলে সড়কপথে গন্তব্যে পৌঁছতে দিনভর কালঘাম ছুটেছে নিত্যযাত্রীদের। ভরসা ছিল মেট্রো। কিন্তু সেখানেও যথারীতি দুর্ভোগ পিছু ছাড়ল না। ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই ফের বিভ্রাট হল মেট্রোয়।
রবিবারের পরে সোমবার। পরপর দু’দিন যান্ত্রিক গোলযোগে ভোগান্তির শিকার হলেন কলকাতা মেট্রোর যাত্রীরা। রবিবার সন্ধ্যা পৌনে ছ’টায় চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে দমদমমুখী একটি নন-এসি রেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়া দেখা দিয়েছিল। আতঙ্কে হুড়মুড়িয়ে পালাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন যাত্রীরা। সোমবার সন্ধ্যায় সেন্ট্রাল স্টেশনে আবার যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ল মেট্রো। নাকাল হলেন যাত্রীরা।
সোমবার সন্ধ্যা তখন সওয়া ছ’টা। সেন্ট্রাল স্টেশনে একটি দমদমমুখী এসি ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। সিগন্যাল সবুজ হয়ে যাওয়ার পরেও দেখা গেল, ট্রেনটি নড়ছে না। বহুক্ষণ কোনও ঘোষণা না হওয়ায় যাত্রীরা বুঝতেই পারছিলেন না ঘটনাটা কী? একটু একটু করে উদ্বেগ বাড়ছিল তাঁদের মধ্যে। অন্য দিকে, কবি সুভাষমুখী ট্রেনগুলি একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে জানা গেল, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাই দমদমমুখী ট্রেনটি যাবে না। অগত্যা রাস্তায় উঠে আসতে হল যাত্রীদের। কিন্তু সেখানে আরও দুর্ভোগ। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের জন্য এ দিন সকাল থেকেই পথে বাস-ট্যাক্সি ছিল নামমাত্র। ফলে খুবই বিপদে পড়েন মেট্রোর যাত্রীরা। পরিস্থিতি সামলাতে শেষে দমদম থেকে গিরিশ পার্ক এবং ময়দান থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত মেট্রো চালানো হয়।
গত ২৩ জুন একটি নন-এসি মেট্রো রেক পার্ক স্ট্রিট ছাড়ার পরেই এমন ঘটনা ঘটেছিল। যান্ত্রিক বিভ্রাটের কারণে অন্ধকারে এক ঘণ্টা সুড়ঙ্গে আটকে থাকতে হয়েছিল যাত্রীদের। এ দিন অবশ্য স্টেশনেই এমন ঘটনা ঘটায় যাত্রীদের ততটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি। তবে ২৩ জুনের সঙ্গে এ দিনের ঘটনার মিল রয়েছে। সে দিনও একটি নন-এসি ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে থার্ড লাইনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিকল হয়ে গিয়েছিল। এ দিনও তাই। এক মাসের মধ্যেই এই ঘটনা আবার কী ভাবে ঘটল, তা নিয়ে অবশ্য কোনও তদন্তের নির্দেশ দেননি মেট্রো-কর্তৃপক্ষ।
গত দু’মাসে মেট্রোয় মোট পাঁচ বার বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। মেট্রো সূত্রের খবর, কোনও ঘটনারই তদন্ত হয়নি। কে বা কারা দোষী, তা-ও চিহ্নিত করা যায়নি গলদটা ঠিক কোন বিভাগের, তা অজানাই থেকে গিয়েছে।
কিন্তু মেট্রোর এই অবস্থা কেন?
মেট্রো সূত্রে জানানো হচ্ছে, এই নিত্য বিভ্রাটের পিছনে দায়ী মেট্রোর নিজস্ব পরিচালন ব্যবস্থাই। এক দফতরের সঙ্গে অন্য দফতরের সমন্বয় কার্যত নেই বললেই চলে। মেট্রো রেলের অফিসারদের একাংশ জানাচ্ছেন, রেল পরিবহণের সর্বোচ্চ পদে থাকেন জেনারেল ম্যানেজার (জিএম)। কিন্তু মেট্রোয় গত দু’বছর কোনও স্থায়ী জেনারেল ম্যানেজারই নেই। রেল সূত্রের খবর, মেট্রো রেলের সর্বশেষ স্থায়ী জিএম ছিলেন পি ভি মূর্তি। ২০১২ সালের জুন মাসে তিনি চলে যাওয়ার পরে যাঁরাই মেট্রোর দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদের মূল দায়িত্ব ছিল অন্য কোথাও। শেষ যিনি মেট্রোর জিএম-এর দায়িত্ব সামলেছেন, সেই রাজীব ভার্গব আদতে ছিলেন রেলওয়ে হুইল ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার। তিনি বসতেন বেঙ্গালুরুতে। ফলে তাঁর পক্ষে সেখান থেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হত না। জুলাই মাস থেকে অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জিএম রাধেশ্যামকেই ফের অতিরিক্ত দায়িত্বে কলকাতা মেট্রোর জিএম হিসেবে কাজ করতে বলা হয়েছে।
তবে ২৩ জুনের ঘটনার দিন ভার্গব কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও সে দিন দুর্ঘটনাস্থলে মেট্রোর কোনও বড় কর্তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি। মেট্রোর এক প্রাক্তন কর্তার মন্তব্য, “মেট্রো এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ, যার প্রতিদিনের কাজকর্ম পর্যালোচনা হওয়ার কথা। ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে তা কী ভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বৈঠক হওয়ার কথা সপ্তাহে অন্তত এক দিন। কিন্তু সে সব উঠে গিয়েছে।”
রবিবার চাঁদনি চকের ঘটনার পরেও মেট্রোর চিফ অপারেশন ম্যানেজার জানিয়েছিলেন, বিভ্রাটের খবর রাখার দায়িত্ব তাঁর নয়। যদিও পরিচালন ব্যবস্থার অন্যতম শীর্ষ কর্তা তিনি। এই প্রসঙ্গেই মেট্রোর এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পরিচালন ব্যবস্থার কী হাল, এই ঘটনাগুলিই তার প্রমাণ।”
যাত্রীরা বলছেন, “দিল্লিতেও মেট্রো চলে। সেখানে তো এমন বিভ্রাটের কথা শোনা যায় না!”
মেট্রো কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দিল্লিতে মেট্রো রেল চালানোর জন্য একটি কর্পোরেশন গঠিত হয়েছে। সেখানে এক জন ম্যানেজিং ডিরেক্টরও রয়েছেন। পেশাদার পরিচালন ব্যবস্থার ফলেই সেখানে বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। সম্প্রতি দিল্লিতেই দরজা খোলা রেখে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে গিয়েছিল মেট্রো। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিভাগীয় তদন্ত শেষ করে দুই কর্মীকে সাসপেন্ড করেছিলেন কর্তৃপক্ষ।
দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় নিত্যকার বিভ্রাটের পরেও কলকাতা মেট্রোয় এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি।
মেট্রো-আতঙ্ক
১০ জুন: শ্যামবাজারের কাছে লাইনে ফাটল।
২৩ জুন: পার্ক স্ট্রিট ছাড়ার পরে বিদ্যুৎ সংযোগে বিঘ্ন। সুড়ঙ্গে এক ঘণ্টা আটকে যাত্রীরা।
২ জুলাই: মহাত্মা গাঁধী রোড স্টেশনের কাছে লাইনে ফাটল।
২০ জুলাই: চাঁদনি চক স্টেশনে মেট্রো রেকে ধোঁয়া। আতঙ্কে হুড়োহুড়িতে জখম ১০।
২১ জুলাই: সেন্ট্রাল স্টেশনে বিদ্যুৎ সংযোগে বিঘ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy