Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

সাধন-সমরে তাঁর অস্ত্র মানুষের ‘শুভবুদ্ধি’

শশীদেবীর সংসারে তলে-তলে অশান্তি বাড়ছিল। গৃহকর্ত্রী নরমে-গরমে ঠেকনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু শাক দিয়ে আর কত মাছ ঢাকা যায়? অতএব, ভোটের মহেন্দ্রক্ষণ কাছে আসতেই বিস্ফোরণ!

নিজের বাড়িতে শশী পাঁজা। মঙ্গলবার। ছবি : স্বাতী চক্রবর্তী

নিজের বাড়িতে শশী পাঁজা। মঙ্গলবার। ছবি : স্বাতী চক্রবর্তী

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৪
Share: Save:

শশীদেবীর সংসারে তলে-তলে অশান্তি বাড়ছিল। গৃহকর্ত্রী নরমে-গরমে ঠেকনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু শাক দিয়ে আর কত মাছ ঢাকা যায়? অতএব, ভোটের মহেন্দ্রক্ষণ কাছে আসতেই বিস্ফোরণ!

এ বার ঘরের লাঠালাঠি এক্কেবারে হাটের মাঝে চলে এসেছে! বিদ্রোহীরা পুরদস্তুর বিদ্রোহসভা ডেকে ফেলেছেন। সেখানে প্রকাশ্য জেহাদ। শশীর হয়ে কোনও কাজ না-করার শপথ নেওয়া হয়েছে। এবং একই সঙ্গে ঘোষণা হয়েছে, ‘‘শশী পাঁজা যদি শ্যামপুকুরের সব ওয়ার্ড থেকে হেরেও যান তা হলেও দলীয় নেতৃত্ব যেন আমাদের দোষ না দেয়। কারণ, আমরা দলীয় কর্মী হওয়া সত্ত্বেও শশী আমাদের কাজ করতে দেননি। বহিরাগতদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। উনি উদ্ধত, ডমিনেটিং। কাউকে মানুষ বলে মনে করেন না।’’

শশীর কাছে সব খবরই আছে। গত সোমবার সন্ধেবেলা টাউন স্কুল মোড়ে মিত্রদের বাগানবাড়ির ওই সভা-র পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট তাঁর কাছে এসেছে। তার পরেও হাঁসের পালক থেকে পাঁক ঝেড়ে ফেলার মতো তুচ্ছতায় হেসে তিনি জানিয়েছেন, এঁদের প্রত্যেককে তাঁর চেনা আছে। এই বিদ্রোহ আর বিশ্বাসঘাতকতাও নতুন নয়। ২০১১ সালেও এঁরা একই ভূমিকায় ছিলেন। এ বারেও সেই ‘ঘরের শত্রু বিভীষণে’রা অনেক এলাকায় গিয়ে ‘সিংহ’ চিহ্নে ছাপ দিতে বলছেন। তবে শ্যামপুকুরের তৃণমূল প্রার্থী মনে করেন, এঁরা সব এলেবেলে-অকিঞ্চিৎকর, কোথাও গিয়ে কল্কে না পাওয়া লোক। এঁদের উপর শশী পাঁজার জয়-পরাজয় নির্ভর করে না। বরং এঁদের ‘কাঠিবাজি’ তাঁর হিসেবের মধ্যেই আছে। তিনি এলাকায় কাজটা করেছেন। তাই শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তাঁর সংসার অটুট রয়েছে, থাকবেও।

‘শত্রু’দের পাণ্ডাও নাকি তাঁর বিশেষ পরিচিত এবং শশী তাঁর নাম করতে মোটেই কুণ্ঠিত নন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, উপর-উপর হাসিমুখে নমস্কার এবং কুশল বিনিময়-ও হয়, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে ছানা প্রথম থেকেই কাটা। ‘‘সাধনদা (পড়ুন সাধন পাণ্ডে)-ই তো এঁদের মাথা। সব সাধনদার লোক। তবে আমি কিন্তু সব জেনেও এত দিন ধরে এঁদের অ্যাবজর্ব করেছি এবং সার্ভাইভ করেছি। দলের ব্যাপার দলের মধ্যেই রেখেছি। এখন মনে হচ্ছে প্রতিবাদ করার সময় এসেছে।’’ — শ্যামপুকুরে তৃণমূলের সংসারের কর্ত্রীর চোখেমুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠছিল।

কিন্তু সাধন পাণ্ডের এ হেন শত্রুতার কারণ কী?

‘‘হিংসা, মাত্রাছাড়া হিংসা! পাঁজা-পরিবারের প্রতি সাধন পাণ্ডে তাঁর ঘেন্না আর বিশ্বাসঘাতকতার পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। অজিত পাঁজা তো সাধন পাণ্ডেকে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাবার (অজিত পাঁজা, শশী-র শ্বশুরমশাই) বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাবলেন, পাঁজাবাড়ি থেকে আর কোনও নেতা-মন্ত্রী বেরোবে না। কিন্তু সেটা তো হয় না। এটা ওঁর হজম হচ্ছে না।’’

শশীর ‘সমস্যা’ অবশ্য শুধু সাধনে সীমাবদ্ধ নেই। ‘বিরোধী’ তালিকায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ হাজারি, পার্থ মিত্র, অতীন ঘোষ, বাপ্পা চৌধূরী, খোকন দাসের মতো ছোট-বড়-মাঝারি অনেক তৃণমূল নেতার নাম উঠে এসেছে। যা শুনে অসহিষ্ণু হয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘‘কে বলেছে সুদীপদার কথা? বাঞ্চ অফ লায়ার্স। পার্থ হাজারি, পার্থ মিত্র, অতীন ঘোষদের সঙ্গেও আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার বিরুদ্ধে সমস্যা তৈরি করছেন একমাত্র সাধন পাণ্ডে।’’

কিন্তু সোমবারের শশী-বিরোধী সভায় শ্যামপুকুরের ৭, ৮, ৯, ১০, ১৭-র মতো ওয়ার্ডের প্রায় ১২০০ কর্মী উপস্থিত ছিলেন। প্রাক্তন কাউন্সিলার পার্থ হাজারি, মঞ্জুশ্রী চৌধূরী-র পাশাপাশি ছিলেন সন্দীপন বিশ্বাস, শোভনগোপাল দত্ত, সমীর মুখোপাধ্যায়, স্বপন ভদ্র ওরফে লয়ে়ডের মতো এলাকার বেশ কিছু নেতা। ওঁরা যদি সবাই মিলে সাবোতাজ করেন তা হলে বাঁচতে পারবেন? একাধিক কাউন্সিলার-নেতা নাকি নিজেদের ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থেকে শশীকে হারাবেন?

এ বার প্রার্থীর চোয়াল শক্ত হল। কেটে-কেটে উত্তর এল, ‘‘সংগঠন কাকে বলে জানেন? জানেন আমি চাইলে কত লোক আনতে পারি? যাঁরা ওই সভায় এসেছিলেন তাঁরা যে সত্যিই ওঁদের লোক নাকি চাপে পড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন সেটা কে বলতে পারে? আর ওঁদের বাদ দিয়ে এলাকার বাকি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা কি নেই নাকি?’’ ততক্ষণে প্রচারে যাওয়ার জন্য বার-বার দলীয় কর্মীদের ফোন আসছে। চেয়ার থেকে উঠে বেরোতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে আমি এলাকায় কী কাজ করেছি লোকে দেখেছেন। কোনওদিন কারও থেকে একটা টাকা খেয়েছি কেউ বলতে পারবে না। যারা দলের বেনোজল তারা দলে থেকে দলবিরোধী কাজ করছে, দল ভাঙছে। মানুষ তাঁদের কাজও দেখছেন। এখন যদি মনে করা হয় যে, মানুষ ওদের কথায় নাচবেন তা হলে শ্যামপুকুরের ভোটারদের বিচারবুদ্ধিকে ছোট করা হবে।’’

নিজের সংসারে ভাঙন আটকাতে শশীদেবী কোমরে আঁচলটা শক্ত করে জড়িয়ে নিচ্ছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

shasi panja assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy