Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সৌজন্য মৃত্যু, সজল-চর্চায় বিশিষ্টেরা

মৃত্যুর ঠিক আগেও আপাত অখ্যাত সজল কাঞ্জিলালের জন্য প্রশাসনের বড় কর্তাদের আসার দরকার পড়েনি। কিন্তু ওই চত্বরের নিয়মিত আগন্তুক সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় ‘সজলদা’ বা ‘সজল’কেও আগলে থাকল। সৌজন্যে একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। 

বিদায়: অ্যাকাডেমি চত্বরে সজল কাঞ্জিলালকে শেষ শ্রদ্ধা। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

বিদায়: অ্যাকাডেমি চত্বরে সজল কাঞ্জিলালকে শেষ শ্রদ্ধা। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৯ ০৩:১৩
Share: Save:

‘চেনা মুখ’ বলে নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরে নিয়মিত অনেকেই চিনতেন তাঁকে। কখনও লিটল ম্যাগাজ়িনের পসরা হাতে হেঁটে বেড়ানো কিংবা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের দিকে শিল্পীর মডেল হয়ে বসে থাকা অকিঞ্চিৎকর চরিত্র জনৈক প্রৌঢ়। বাঙালির সংস্কৃতি-কেন্দ্রের তকমাপ্রাপ্ত ওই তল্লাটে জীবনের শেষযাত্রায় তিনিই কার্যত ‘নায়ক’ হয়ে উঠলেন।

সাধারণত সংস্কৃতি-জগতের কোনও ইন্দ্রপতনের পরেই এমন দৃশ্য দেখা যায়। সাম্প্রতিক অতীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অজস্র যশস্বী বাঙালিকে দেখতে এই রবীন্দ্র সদন তল্লাটে ভেঙে পড়েছে প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে সাধারণ অনুরাগী। মৃত্যুর ঠিক আগেও আপাত অখ্যাত সজল কাঞ্জিলালের জন্য প্রশাসনের বড় কর্তাদের আসার দরকার পড়েনি। কিন্তু ওই চত্বরের নিয়মিত আগন্তুক সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় ‘সজলদা’ বা ‘সজল’কেও আগলে থাকল। সৌজন্যে একটি মর্মান্তিক মৃত্যু।

অজস্র নামী-অনামী নাট্যকর্মী থেকে চিত্রশিল্পী ভিড় করেছিলেন, সজলদাকে দেখতে। একাডেমির ক্যান্টিনের জনৈক কর্মচারী সজল চোখে বলছিলেন, ‘‘ওই চত্বরটা ছাড়া একটা দিনও সজলদা থাকতে পারতেন না। এত লোকে ওঁকে ভালবাসেন, তা কি উনি সত্যিই জানতেন?’’

ভালবাসা বা বেদনার অর্ঘ্য অবশ্য উপচে পড়েছে শনিবার রাত থেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ার স্মৃতিচারণে শামিল কবি সুবোধ সরকার থেকে শিল্পী প্রদোষ পালও। রয়েছেন আর্ট কলেজের আরও অজস্র প্রাক্তনী। তাঁরা অনেকেই বলছেন, যে ভাবে

তাঁদের প্রিয় ‘কাঞ্জিলালদা’র মৃত্যু হয়েছে, তা ভয়ঙ্কর, ক্ষমার অযোগ্য। মানুষ হিসেবে মৃত্যুর সময় যে সম্মানটুকু প্রাপ্য, সেটুকু ফিরিয়ে দিতেই অনেকে এ দিন রবীন্দ্রসদন চত্বরে গিয়েছিলেন।

ফেসবুকে ‘সজলদা’র ছবি শেয়ার করে সুবোধ সরকার লিখেছেন, ‘‘সজলদা লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন। এর চেয়ে পবিত্র আর কী আছে পৃথিবীতে? তাঁকে তোমরা এ ভাবে মেরে ফেললে, মেট্রো?’’ সমস্ত লাইফ স্টাডির মডেলদের পাশে দাঁড়াতে শিল্পীদের ডাক দিয়েছেন প্রদোষ পাল। তাঁর কথায়, ‘‘এই সব মডেলদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাইছি। শিল্পীদের তরফে ফান্ড তৈরি ছাড়াও সরকারের কাছে এ নিয়ে আর্জি জানানোরও চেষ্টা করা হবে। কাঞ্জিলাল আর ফিরবে না, কিন্তু যে কাঞ্জিলালেরা ধুঁকছেন তাঁদের পাশে আমরা দাঁড়াতে চাই।’’

কাঞ্জিলাল অবশ্য আছেন আর্ট কলেজের অজস্র ছাত্রের সৃষ্টিতে, বলছেন বহু বর্তমান ছাত্র, প্রাক্তনীরাও। কয়েক মাস আগেই পোট্রেটের ক্লাসে কাঞ্জিলালদার ছবি এঁকেছেন সরকারি আর্ট কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র টনি দত্ত। তাঁর মনে পড়ছে, ‘‘সময় পেরিয়ে গেলেও যদি আমাদের কারও ছবি বা ভাস্কর্যের কাজ শেষ না হত, যত ক্ষণ প্রয়োজন কাঞ্জিলালদা অপেক্ষা করতেন। কেবল পেশাদার মডেল নন, শিল্পকে অত্যন্ত ভালবাসতেন তিনি।’’ দরকার পড়লে ছাত্রদের বাড়িতেও চলে যেতেন তিনি। সে জন্য বাড়তি পারিশ্রমিকও কখনও চাইতেন না বলেই জানাচ্ছেন ছাত্রেরা।

নদিয়ার রানাঘাটের সুমিত সরকারের মনে পড়ছে ২০০৮ সালের কথা। সুমিত তখন আর্ট কলেজের ছাত্র। সুমিত বলেন, ‘‘আমরা ওঁকে কাঞ্জিলালকাকা বলতাম। দ্বিতীয় বর্ষে পোট্রেট বানানোর সময়ে দিনে প্রায় ঘণ্টাচারেক করে পাঁচ দিন মতো সিটিং দিয়েছিলেন উনি। ফাইবারের তৈরি ওঁর মূর্তিটা আজও আমার রানাঘাটের বাড়িতে রয়েছে। সব সময়ে মুখে হাসি। কোনও দিন রাগ দেখিনি ওঁর মুখে।’’ সজলবাবুর এই সদাহাস্যময় মুখের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল আর্ট কলেজের বাইরেও। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অ্যানিমেশন বিভাগেও মডেলের কাজ করতেন তিনি। সেখানকার ছাত্র সুশ্রুত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মুখে হাসিটাই যেন ছিল ওঁর পরিচয়।’’

মৃত্যুর পরে সেই হাসিমুখটার স্মৃতিই তীব্র যন্ত্রণার জন্ম দিচ্ছে। কয়েক জনের প্রশ্ন, মেট্রো কর্তৃপক্ষের তরফে অন্তত কেউ এলে একটা মানবিকবার্তা উঠে আসত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy