বঙ্গভবনে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম করেই বাড়ির পথে পাড়ি। রাতে কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে পা দিয়েই বাবা-মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন আদরের পুকু। সব কিছু শান্ত হলে হয়তো আবার ইউক্রেন ফিরে যাবেন নিউরোসাইকায়াট্রিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখা অন্বেষা।
আদর: বেলুড়ের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অন্বেষা দাস। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
পুরো এক মিনিটও নয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য সামান্য ফাঁক করা হচ্ছে লোহার ছোট গেট। সেই সুযোগে যত জন সম্ভব পেরিয়ে যেতে হবে ইউক্রেন-রোমানিয়া সীমান্ত। এক বার না পারলে, আবার অপেক্ষা কিছু ক্ষণের। মন শক্ত করে শরীরকে টেনে ভিড়ে ঠাসা সীমান্তের ওই গেটের দিকে এগিয়ে ছিলেন টার্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারি পড়ুয়া অন্বেষা দাস।
দিনটা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। সীমান্ত পেরোনোর ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে মাঝেমধ্যেই শূন্যে গুলি ছুড়ছিল ইউক্রেন সৈন্য। এতে বিচলিত হননি ক্যারাটেতে ব্ল্যাক-বেল্ট পাওয়া বেলুড়ের অন্বেষা। বরং বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সীমান্তে পৌঁছে ভিড় ঠেলে সাড়ে ১১টায় তিনি গিয়েছিলেন গেটের সামনে। তাঁর কথায়, “শুনেছিলাম রাত একটা নাগাদ গেট বন্ধ হয়। আবার পরদিন সকালে খুলবে। কানে বাজছিল মায়ের কথা, ‘বাবু তুই বাড়ি ফিরে আয়।’ সেটাই মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল।” সোমবার রাতে বেলুড়ের বাড়িতে ফিরেছেন ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষের ওই পড়ুয়া। যুদ্ধের আঁচ পেয়ে ৮ মার্চ উড়ানে দেশে ফেরার টিকিট কেটে ফেলেছিলেন অন্বেষা। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে প্রথম বিস্ফোরণ। তরুণীর কথায়, “শুনলাম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অনলাইনে পড়া শুরু হল। সন্ধ্যে হলেই হস্টেলের আলো নিভিয়ে দিতাম। সাইরেন বাজলেই বাঙ্কারে ছুটতাম।”
দুশ্চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারতেন না মা কোয়েলা দাস। জানালেন, যুদ্ধ শুরুর খবর পেয়েই তাঁরা টিকিট খুঁজলেও মেলেনি। রাতে মাথার কাছে রাখা মোবাইলে মেসেজ আসার আওয়াজ শুনেই উঠে বসতেন। মোবাইলের চার্জ শেষ হওয়ার ভয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করার বদলে মেসেজ করতেন অন্বেষা। জানাচ্ছেন, ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে হস্টেল থেকে বাসে চেপে রোমানিয়া সীমান্তের কাছাকাছি আসেন তিনি ও সঙ্গীরা। প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছন সীমান্তে। অন্বেষা বলেন, “রাস্তায় ইউক্রেনের লোকজন শুকনো খাবার-জল দিয়েছিলেন। সীমান্ত পার করে মোবাইলের ইন্টারনেট কাজ করছিল না। তখন কানাডায় থাকা দিদিকে ফোনে কথা বলে সব জানাচ্ছিলাম।” বড় মেয়ের থেকে ছোট মেয়ের গতিবিধির খবর পাচ্ছিলেন বেলুড়ের দাস দম্পতি। সীমান্ত পেরিয়েই ভারতীয় দূতাবাসের বাসে উঠেছিলেন অন্বেষা। রাত ১টায় বাস ছেড়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা নাগাদ পৌঁছন রোমানিয়ার বিমানবন্দরে। সেখান থেকে দুপুর আড়াইটেয় দিল্লির উড়ানে চেপে পরদিন অর্থাৎ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে পৌঁছন অন্বেষা।
বঙ্গভবনে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম করেই বাড়ির পথে পাড়ি। রাতে কলকাতা বিমানবন্দরের বাইরে পা দিয়েই বাবা-মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন আদরের পুকু। সব কিছু শান্ত হলে হয়তো আবার ইউক্রেন ফিরে যাবেন নিউরোসাইকায়াট্রিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখা অন্বেষা। তবে তাঁর এখনকার মানসিক চাপ কাটাতে মরিয়া গোটা পরিবার। পাহাড়ে বেড়ানোর পরিকল্পনা থেকে পছন্দের বিউলির ডাল, পোস্ত, মাছ ভাজা, মাংস রেঁধেছেন মা। আর দাদু অনন্তবাবু বলছেন, “দিদিভাই সব খেতে হবে তোমায়।” বোমা-গুলির আওয়াজ, বাঙ্কারে আশ্রয়ের স্মৃতি ভোলাতে কোয়েলাদেবী মাঝেমধ্যে গেয়ে শোনাচ্ছেন পুকুর পছন্দের গান, ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ...।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy