সমাধান করেছিলেন, এবং করতে পারেননি, দু’ধরনের কেসের কথাই লিখেছেন প্রিয়নাথ। তাঁর দেখা ভয়ঙ্করতম অপরাধীদের মধ্যে এক জন ছিল ত্রৈলোক্যতারিণী। ব্রিটিশ পুলিশদের চোখে ধুলো দিয়ে বার বার বেঁচে যেত এই বাঙালি তরুণী। একাধিক খুন ও লুঠপাটের পরে অবশেষে তাকে ধরতে সমর্থ হন প্রিয়নাথ। সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছিলেন নিজের পত্রিকায়। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন করেছিলেন স্থান-কাল-পাত্র।
সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের ভয়ে ত্রস্ত ছিল উনিশ শতকের লন্ডন। শিকারের দেহ চিরে খুন করার ধরন থেকে তার নামের সঙ্গে জুড়েছিল ‘রিপার’ শব্দটি। তার পরিচয় এবং সে নিজে অধরাই থেকে যায় লন্ডন পুলিশের কাছে। কিন্তু জ্যাক দ্য রিপারেরও আট বছর আগে কলকাতায় একের পর এক তরুণীকে খুন করত ত্রৈলোক্যতারিণী। এবং তা করত স্রেফ গয়নার লোভে। খুনের পাশাপাশি সিদ্ধহস্ত ছিল অন্য অপরাধেও।
ঠান্ডা মাথার খুনিতে পরিণত হওয়া ত্রৈলোক্যর জীবন শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি, বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের মধ্যে সুন্দরী হিসেবে খ্যাতি ছিল ত্রৈলোক্যতারিণী দেবীর। সব রকম সামাজিকতা মেনে ত্রৈলোক্যর জন্য পাত্র জোগাড় করতে সে সময়ের প্রেক্ষিতে কিছুটা দেরি-ই হয়ে যায়। তেরো বছর বয়সে ত্রৈলোক্যর বিয়ে হয় ষাটোর্ধ্ব এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে।
কিন্তু স্বামীর সঙ্গে সংসার কোনওদিন আক্ষরিক অর্থেই করেনি সে। একাধিক স্ত্রী-র স্বামী ওই প্রৌঢ় ত্রৈলোক্যতারিণীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাননি। সতীনদের সঙ্গে সংসার করার ইচ্ছে ছিল না ত্রৈলোক্যতারিণীর নিজেরও। শ্বশুরবাড়ির বদলে তার দিন কাটতে থাকে গ্রামের বাড়িতেই। কয়েক বছ পরে প্রৌঢ়ের মৃত্যু হওয়াতে শ্বশুরবাড়ির দরজা বন্ধই হয়ে যায় তার জন্য। গ্রামে নিঃসঙ্গ জীবনে পরিচয় হয় এক বৈষ্ণবীর সঙ্গে।
সেই বৈষ্ণবীর মারফত ত্রৈলোক্যতারিণীর সঙ্গে আলাপ হয় এক যুবকের। তার সঙ্গেই ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয় সম্পর্ক। ওই বৈষ্ণবীর বাড়িতেই মাঝে মাঝেই গোপনে দেখা হত তাদের। এর পর একদিন মারা যান বৃদ্ধা বৈষ্ণবী। কিছু দিনের মধ্যে ত্রৈলোক্যতারিণীর গোপন সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেল। প্রণয়ীর সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা পৌঁছল ত্রৈলোক্যতারিণী।
কিন্তু নিপাট নিটোল সংসার তার কাছে কোনওদিন ধরা দেয়নি। ত্রৈলোক্যতারিণীকে কলকাতার নিষিদ্ধপল্লি তেরাখে তার প্রণয়ী। গ্রাম থেকে সদ্য কলকাতায় পা রাখা তরুণী জানতও না ওই এলাকার বৈশিষ্ট্য। যখন টের পেল, তখন ফেরার পথ বন্ধ। বুঝল, ওই পরিবেশেই তাকে থাকতে হবে। ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হতে থাকল সোনাগাছির প্রচলিত রীতিনীতিতে।
ক্রমশ মক্ষীরানি হয়ে দেখা দিল ত্রৈলোক্যতারিণী। এর মধ্যেই এক দিন মারা গেল তার প্রণয়ী। কিন্তু তখন তার কোনও অর্থকষ্ট নেই। এ ভাবেই কাটল দেড় দশক। এমন সময়ে তার জীবনে এল জনৈক কালীবাবু। পরবর্তীকালে সে-ই ছিল ত্রৈলোক্যর মূল প্রণয়ী এবং সেই সঙ্গে অপরাধের চক্রী। কিন্তু বেশি দিন সেরা সময় থাকল না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে ত্রৈলোক্যতারিণীর জনপ্রিয়তা। কিন্তু জীবনের দুঃসময়েও তার পাশে ছিল কালীবাবু। এমনকি, স্ত্রীবিয়োগের পরে তার একমাত্র ছেলেকে বড় করে তোলে ত্রৈলোক্যতারিণী।
কালীবাবু শিকার ধরত। তারপর নিজের জালে জড়িয়ে তাদের সর্বনাশ করত ত্রৈলোক্যতারিণী। ঠিকানা পাল্টে নিজের সাজানো পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে দিত অন্য শহরের বিত্তবান পাত্রের। পাত্রীর সঙ্গে যেত তার সাজানো আত্মীয়স্বজন। তার পর সুযোগ বুঝে সব গয়নাপত্র নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে আসার নাম করে পালিয়ে আসত ‘নতুন বউ’। সঙ্গে তার ‘পরিজনরা’। পরে ভুয়ো ঠিকানায় গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না।
পর পর অপরাধ করেও ধরা না পড়ায় সাহস বাড়ছিল তাদের। এর পর কলকাতার রাস্তা থেকে শিশুকন্যাদের অপহরণ তারা। সে সময় কিছু পরিবারের বিয়েতে কন্যাপণ দেওয়ার রীতি ছিল। সে রকম পরিবারে অপহৃত বালিকাদের বিয়ে দিত ত্রৈলোক্যতারিণী। পুলিশের তৎপরতায় এক দিন বন্ধ হলে সেই চক্র। কিন্তু ত্রৈলোক্যতারিণীর টিকির খোঁজও পেল না পুলিশ। এক চক্র বন্ধ হলে নিত্যনতুন চক্র খুঁজে বার করত তারা।
এ ভাবে এক বার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে পুলিশের জালে ধরা পড়ে গেল দু’জনেই। গয়নার লোভে তারা খুন করেছিল এক দেশীয় রাজ-এস্টেটের কর্মচারীকে। সেই মামলায় আইনের বিচারে কালীর প্রাণদণ্ড হয়। কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় ত্রৈলোক্যতারিণী। এর পর সে ঠিক করে অন্ধকারের পথ থেকে সরে যাবে। অর্থকষ্ট হলেও শুরু করবে নতুন জীবন। সেইমতো পালিত সন্তানকে নিয়ে সোনাগাছি ছেড়ে থাকতে লাগল অন্য পাড়ায়। কিন্তু বেশি দিন দারিদ্র সহ্য করতে পারল না ত্রৈলোক্যতারিণী। অনটনের জায়গায় তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল অতীতের সোনালি দিনের মোহ।
পুলিশের দাবি, ত্রৈলোক্য স্বীকার করেছে, এর পর সে তার ‘শিকারদের’ বলত গুরুদেবের কাছে যাওয়ার আগে বাগানবাড়ির পুকুরে স্নান করে নিতে। তার আগে সব গয়না খুলিয়ে নিজের কাছে রেখে দিত। এর পর পুকুরে স্নান করার সময় শিকারকে ডুবিয়ে মারত সে। এ ভাবে তিন বছরে পাঁচ জনকে মেরে তাঁদের গয়না লুঠ করেছিল ত্রৈলোক্য। ওই পুকুর থেকে একের পর এক দেহ উদ্ধার হলেও ত্রৈলোক্যকে কেউ ধরতে পারেনি।
কিন্তু ত্রৈলোক্য ধরা পড়ে গেল ষষ্ঠ বার। অপরাধের সময় পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল এক জন। ফলে ধরা পড়ে যায় ত্রৈলোক্য। বেঁচে যায় তার ষষ্ঠ শিকার। কিন্তু এ বারও সে ছাড়া পেয়ে গেল প্রমাণাভাবে। শাস্তির হাত থেকে বাঁচলেও সোনাগাছির পুরনো পাড়ায় পড়শিদের চোখে সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। বদনাম এড়াতে পালিত ছেলে হরিকে নিয়ে সে এসে উঠল চিৎপুরের পাঁচু ধোপানি লেনের এক বাড়িতে। সরাসরি নিষিদ্ধ এলাকা না হলেও ওই বাড়ির বাসিন্দারা জড়িত ছিল দেহব্যবসার সঙ্গেই।
সেখানে থাকতে থাকতেই কয়েক বছরের মধ্যে আবার ত্রৈলোক্যতারিণীর মধ্যে জেগে উঠল রক্তের নেশা। এ বার সে নিশানা করল ওই বাড়িরই আর এক ভাড়াটে তরুণীকে। তার গয়না লুঠ করাই ছিল ত্রৈলোক্যর লক্ষ্য। অনেক দিন ধরে ছক কষতে থাকে সে। ষড়যন্ত্রের সঙ্গী করে আর এক ভাড়াটেকে। দু’জনে মিলে খাবারে মাদকদ্রব্য মিশিয়ে অচৈতন্য করে ওই তরুণীকে। তার পর তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়।
শেষে প্রিয়নাথের সাজানো ফাঁদে ধরা দিতে বাধ্য হয় ত্রৈলোক্যতারিণী। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধ স্বীকার করে সে। নিজের ঘরের লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেয় খুনের পরে নিহত তরুণীর লুঠ করা গয়না। এই ঘটনায় তার ফাঁসির শাস্তি হয়। অপরাধের ইতিহাসে এখানেই শেষ তার অধ্যায়। কলকাতা পুলিশের নথিতে সে-ই সম্ভবত প্রথম সিরিয়াল কিলার। তার বিচিত্র জীবনের কথা নিজের পত্রিকা ‘দারোগার দপ্তর’-এ, ১৩০৫ বঙ্গাব্দে লিখেছিলেন দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ১১৯ বছর পেরিয়ে আজও সেই বিবরণ সমান রোমহর্ষক। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy