অবৈধ: ওই স্কুলের ভিতরে এ ভাবেই চলে খাটাল। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
জেলায় জেলায় লোকেরা আছেন। তাঁরাই যোগাযোগ রাখেন জেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে। দৃষ্টিহীন বা ক্ষীণ দৃষ্টির ছেলে-মেয়ের সন্ধান পেলেই তাঁরা চলে যান তাদের বাড়িতে। বাবা-মাকে ‘স্বপ্ন’ দেখানো হয় সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। এর পরে বাবা-মা ও বাচ্চাকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার হোমে। ঘুরিয়ে দেখানো হয় সবটা। স্কুল বা হোমের ভবন এমনই ঝাঁ-চকচকে যে, আলাদা কিছু ভাবার জায়গাতেই থাকেন না সেই বাবা-মায়েরা।
তার পরে?
খুব কম বয়সে চলে আসা সেই ছেলেমেয়েদের কী পরিণতি হয়, অনেক ক্ষেত্রেই কেউ সে সবের খোঁজ রাখেন না। সেই মা-বাবাদেরও অনেক সময়ে আর দেখা পাওয়া যায় না। শুধু কখনও কিছু ‘অন্য রকম খবর’ এলে ছুটে আসেন কেউ কেউ! হরিদেবপুর থানা এলাকার জোকায় দৃষ্টিহীনদের স্কুল তথা হোমের বাইরে শনিবার যেমন ছুটে এসেছিলেন বেশ কয়েক জন অভিভাবক। তাঁদেরই এক জন, খড়্গপুর থেকে আসা মাঝবয়সি ব্যক্তি ‘এজেন্ট’-এর হাত ঘুরে মেয়ের স্কুলে আসার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন, ‘‘আমার মেয়ের ১৩ বছর বয়স। মাস সাতেক হল, এখানে এসেছে। গরমের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে এ বার শুধু বলছিল, এখানে কী সব খারাপ কাজ হয় ওদের সঙ্গে। কিন্তু গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, বাড়িতে চলে আসতে চায়। তাই বানিয়ে বলছে। এখন দেখছি, মিথ্যে বলছিল না!’’ পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীর চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। কোনও মতে তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটাকে ফিরে পাব তো? এই স্কুলের ভিতরে বাড়িঘর সব এতই ভাল যে, মেয়েটা ভাল থাকবে ভেবে লোভ হয়েছিল। সেই লোভের যে এই পরিণতি হতে পারে, ভাবিনি।’’
জোকার ওই স্কুল তথা হোমের মালিক জাভেস দত্ত, অধ্যক্ষা কাবেরী বসু এবং রাঁধুনি বাবলু কুণ্ডুকে ইতিমধ্যেই আবাসিকদের ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের তিনটি মামলায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কোনও মতে ওই স্কুলের ভিতরে ঢুকতেই মালুম হয়, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকা থেকে আসা দৃষ্টিহীন আবাসিকদের অভিভাবকদের দাবি ভুল নয়। রীতিমতো এলাহি ব্যবস্থা। গোটা চত্বর সিসি ক্যামেরায় মোড়া। স্কুলের জায়গা সব মিলিয়ে পাঁচ বিঘারও বেশি। সেখানেই রয়েছে একাধিক ভবন। কোনওটি ক্লাসঘর এবং আবাসিকদের থাকার জায়গা হিসাবে ব্যবহার হয়, কোনওটি রয়েছে বিয়ে বা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার জন্য। রয়েছে খেলার মাঠ, অনুষ্ঠান মঞ্চ, রান্নার জায়গা এবং গাড়ি বারান্দা। নানা ব্র্যান্ডের একাধিক গাড়ি রাখা সেখানে। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে খড়ের গাদা ও গরুও! এখানে কি খাটালও রয়েছে? মশা-মাছি ভন ভন করছে চার দিকে। ইতিউতি পড়ে রয়েছে গোবর। তার মধ্যেই একটি ঘরে গাদাগাদি করে রাখা তিনটি পূর্ণবয়স্ক গরু। কিন্তু কলকাতায় তো এমন খাটাল চালানো বেআইনি! কথা থামিয়ে দিয়ে নিজেকে স্কুলের অন্যতম কর্তা বলে দাবি করে উত্তম দত্ত নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘আবাসিক বাচ্চারা দুধ খায়। খাটালে গরু-ছাগল সবই আছে। কেউ এক জন খুশি হয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ফেরাইনি।’’ কিন্তু পুরসভা বা পুলিশ কিছু বলে না? উত্তম স্পষ্ট উত্তর দেন না।
উত্তম দ্রুত ফিরে যান ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহের অভিযোগ প্রসঙ্গে। দাবি করেন, ‘‘তিন বছর বয়স থেকে ২২-২৩ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা এখানে থাকে। এখানে কর্মশিক্ষারও নানা অনুষ্ঠান হয়। তেমনই এক অনুষ্ঠানে এই হোমেই বড় হওয়া একটি দৃষ্টিহীন মেয়ের সঙ্গে এক দৃষ্টিহীন যুবকের সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা বিয়ে করে। তাদের ছেলে হয়। বছর পাঁচেকের সেই দৃষ্টিহীন ছেলেকে তার মা এখানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এসে বাচ্চাটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় সে। আমরা শিক্ষক দিবস পেরিয়ে গেলে ওকে ছাড়ব বলায় মেয়েটি পুলিশ নিয়ে আসে। আমাদের সন্দেহ, বাচ্চাটির ওই মা-ই বাইরে গিয়ে কুৎসা করছে।’’
শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় অবশ্য এ দিনও বলেন, ‘‘আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু বেরোবে। আসল চিন্তা ছিল, বাচ্চাগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সেটা করা গিয়েছে।’’ কিন্তু এমন সব অনিয়ম কি এত দিন পুলিশ-প্রশাসনের নজরে পড়েনি? পুলিশের তরফে কেউই মন্তব্য করেননি। এলাকাটি কলকাতা পুরসভার ১৪২ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি রঘুনাথ পাত্রের দাবি, ‘‘এমন ঘেরাটোপে ওই স্কুল চলত যে, ভিতরে কী হচ্ছে, বোঝা যেত না। এক বার টিকার একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পিছন দিকে ওদেরই জমিতে মনে হয় গরু রাখা হয়।’’ তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? ওই চত্বরের কত জনের বিরুদ্ধে গরু রাখার কারণে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা জানিয়ে রঘুনাথ বলেন, ‘‘এ বার স্বাস্থ্য দফতরের নোটিস দেব। ওরা সরিয়ে নিলে ভাল, নয়তো আইনি পদক্ষেপ করা হবে।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy