মানিকতলা এলাকায় বেআইনি নির্মাণ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
একই বাড়ির জন্য তিন রকম ‘রেট চার্ট’! যাঁর ছেলেরা বাড়ির নির্মাণ সামগ্রী দেবেন, সেই দাদা নেবেন প্রতি বর্গফুটে ২০০ টাকা। যে জনপ্রতিনিধি বিধি উড়িয়ে বাড়ি তৈরির অনুমোদন পাইয়ে দেবেন, তিনি নেবেন প্রতি বর্গফুটে ৫০০ টাকা। আর সব জেনেও যাঁরা ধরপাকড় না চালিয়ে ‘সহায়তা’ করবেন, তাঁদের দিতে হবে প্রতি বর্গফুটে ৩০০ টাকা!
এই ভাগাভাগির হিসেবের উপরে দাঁড়িয়েই শহর জুড়ে বেআইনি নির্মাণের রমরমা চলছে বলে অভিযোগ। যে বাড়ি একতলার বেশি উঁচু হওয়ার কথা নয়, সেখানে সহজেই পাঁচতলা উঠে যাচ্ছে। জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে ছ’তলার চারটি টাওয়ার বিশিষ্ট আবাসন। অভিযোগ, দেদার দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি রাস্তাও! লকডাউন পর্বে দাদাদের এই আয় প্রায় থমকেই গিয়েছিল। তবে আনলক পর্বের শুরু থেকেই নয়া উদ্যমে এই আয়ের কড়ি দাদাদের ঘরে তোলার প্রক্রিয়া ফের শুরু হয়েছে। পুর দফতর সূত্রের খবর, কিছু কিছু জায়গায় আবার এখন হিসেব পুরোটাই নির্ধারিত হচ্ছে ভোটের হাওয়ার নিরিখে। জনপ্রতিনিধি যে দিকে রয়েছেন, বেআইনি বাড়ির প্রোমোটারও সেই দিকে থাকলে হিসেব এক রকম। নয়তো দিতে হচ্ছে তিন-চার গুণ বেশি টাকা!
যাদবপুর শ্রীকলোনির এক বাসিন্দার দাবি, “বছরখানেক হয়ে গিয়েছে পুরনো বাড়ি প্রোমোটিংয়ের জন্য দিয়েছিলাম। তখন পাড়ার নেতা-দাদার সঙ্গে প্রোমোটারের খাতির ছিল। ভোটের আগে তিনি উল্টো পথে হাঁটছেন। তাই আমাদের বাড়ি তো বটেই, ওঁর আরও তিনটে কাজ আটকে দিয়েছেন নেতা-দাদা।” বেলেঘাটার এক প্রোমোটারের মন্তব্য, “এখনই হিসেব বিগড়োলে মুশকিল। কলকাতায় তো তেমন কিছু উল্টোয়নি। পুর ভোটটাই হল না। ভোটের পরে উল্টোলে আমরাও হিসেব বুঝে নেব। তা ছাড়া, দাদা যে পক্ষেরই হোন, তাঁর হাত মাথায় না থাকলে এ সব করা যায় না।”
বেআইনি বাড়ির ‘রেট চার্ট’
• নির্মাণ সামগ্রীর সিন্ডিকেটের দাদা নেবেন ২০০ টাকা
• জনপ্রতিনিধির ‘অনুমোদন আশীর্বাদ’ পেতে ৫০০ টাকা
• ধরপাকড় এড়ানোর ‘সহায়তা’ পেতে খরচ ৩০০ টাকা
• জলের সংযোগ পেতে এক লক্ষ টাকা, অনুগামী না হলে খরচ বাড়তে পারে
• ভোটের আগে এক দাম, পরে হাওয়া বুঝে দাম বাড়তে পারে
(হিসেব প্রতি বর্গফুটে)
কী সব? এই ‘দাদার হাত মাথায় থাকার’ জেরে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার কথা জানালেন শহরের বাসিন্দারা। শ্যামপুকুর ফুলবাগান এলাকার এক বাসিন্দা যেমন বললেন, “ধরুন একতলা বাড়িতে পাঁচ ঘর বাসিন্দা ছিলেন। প্রতি ঘরে গড়ে চার জন করে মোট ২০ জন। এখন সেই বাড়িই রাতারাতি পাঁচতলা হয়ে যাচ্ছে। বাসিন্দার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬০। কিন্তু বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় এত জনের পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই।” টালিগঞ্জের একটি বস্তির বাসিন্দার মন্তব্য, “প্রোমোটার জলের নয়া সংযোগ নেওয়ার টাকা খরচ করছেন না। বেআইনি বহুতলে যাঁরা ফ্ল্যাট কিনে আসছেন, তাঁরা পুরসভার দাদাদের ধরে রাস্তার জলের পাইপ থেকেই পাম্প লাগিয়ে জল টেনে নিচ্ছেন। ফলে জলের গতি গোটা পাড়াতেই তলানিতে। দেখা যাচ্ছে, যিনি অনুমোদন নিয়ে বাড়ি করেছেন, তাঁর বাড়িতেই জল পড়ছে সরু সুতোর মতো!”
শহরের প্রোমোটার মহল সূত্রের খবর, বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় এই ধরনের বহুতলে জলের নতুন সংযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ‘টেবিলের তলা দিয়ে’ কাজ করাতে বাড়ি-পিছু গুনতে হয় অন্তত এক লক্ষ টাকা। এ ক্ষেত্রেও কাছের লোক বা বিরোধী দলের লোক— ইত্যাদি বিভাজন আছে। দাদার মর্জির উপরেই ঠিক হয় টাকার হিসেব। ফলে ফ্ল্যাট কিনে যাঁরা আসছেন, প্রোমোটারেরা তাঁদেরই ব্যবস্থা করে নিতে বলেন। জলের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শহরে ফ্ল্যাট বিক্রিতে ভাটা নেই বলেই দাবি প্রোমোটারদের। কিছু ক্ষেত্রে এই সব ফ্ল্যাটের দাম বৈধ ফ্ল্যাটের দামকেও টেক্কা দেয়!
শহর জুড়ে বেআইনি নির্মাণের এই রমরমা কি ভাগের হিসেব ঘরে তোলার সুবিধার কথা ভেবেই বন্ধ হয় না? কলকাতা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান প্রথমে মন্তব্য করতে না চাইলেও পরে বলেন, “এ সব বিরোধীদের অভিযোগ। কেউ কিছু নেয় বলে শুনিনি।” কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক শীর্ষ আধিকারিক যদিও বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে প্রভাব থাকে এটা সত্যি। তবে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
অভিযোগ, সেই প্রভাবেই এই মুহূর্তে ফ্ল্যাটের কাটতি বাড়ানোর পথে হাঁটছেন বহু এলাকার নেতা-দাদারা। উত্তর কলকাতার সব চেয়ে বড় বরো কমিটির এক জন প্রতিনিধি বললেন, “এখনই যা করার করে নিতে হচ্ছে। ভোটের পরে কোন পথে সব যাবে, জানা নেই। দামের হিসেবই বা কী দাঁড়াবে কেউ জানে না। ভোটের পরে কী হবে ভেবে লোকসান করা যাবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy