অরক্ষিত: ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনার পরে পাহারা বাড়ানো হলেও নজরদারির ঘর ফাঁকাই। মঙ্গলবার, বিদ্যাসাগর সেতুতে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
কেউ সম্পূর্ণ শরীর বাইরের দিকে রেখে স্রেফ পায়ের বুড়ো আঙুলের ভরসায় ছাদের কার্নিশ লাগোয়া জলের পাইপের উপর দিয়ে হাঁটছেন। কেউ আগুনের ফুলকি বেরোতে থাকা বিদ্যুতের তার ধরে ঝুলে ঝুলে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার দ্রুত গতিতে থাকা লরির স্টিয়ারিং ছেড়ে উঠে, চালকের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন। তার পরে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ধরে ঝুলে ঝুলে এসে খালাসির দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে ফের স্টিয়ারিং ধরছেন!
অত্যন্ত বিপজ্জনক অথচ জনপ্রিয়, এমনই ভিডিয়োর রমরমা সোশ্যাল মিডিয়ার সাইট জুড়ে। এতটাই যে, বহু সংস্থাই এই মুহূর্তে এ ধরনের ভিডিয়োর জোরে একের পর এক ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনস চালু করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ। ‘ভিডিয়ো কনটেন্ট’ সরাসরি চেয়ে নেওয়া হচ্ছে ওয়েবসাইট বা অ্যাপের ব্যবহারকারীদের থেকেই। বিনা খরচে প্রচার পাওয়ার হাতছানি তো থাকছেই, সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে ঘরে বসে অর্থলাভের টোপও! অনেকেই খুলে নিচ্ছেন এমন ভিডিয়োর নিজস্ব ব্লগ বা ‘পেজ’! আর এর জেরেই রীতিমতো জীবন বাজি রেখে দেদার চলছে বিপজ্জনক ভিডিয়ো শুট। বহু ক্ষেত্রেই এমন ভিডিয়ো তুলতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে অনেকেরই। গত কয়েক বছরে এমন ঘটনার উদাহরণ সামনে এসেছে দেশের প্রায় সব প্রান্ত থেকেই।
সোমবারই যেমন দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন দুই যুবক। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি এক জনের। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য অবশ্য তৈরি হয়েছিলেন আরও এক যুবকও। যদিও দ্বিতীয় জনকে তলিয়ে যেতে দেখে তিনি আর সাহস করেননি। ঝাঁপের সেই ভিডিয়ো তুলে রাখছিলেন তাঁর বন্ধুরাই। তাঁদের এ-ও বলতে শোনা যায়, ‘‘এক দিন না এক দিন তো মরতে হবেই, তা হলে আজ নয় কেন?’’
এর পরেই বলতে শোনা যায়, ‘‘বিপদের এই খেলায় সকলকে স্বাগত।’’ পুলিশেরই একটি অংশের দাবি, এই যুবকদের উদ্দেশ্য এখনও স্পষ্ট না হলেও পরিচিতি পাওয়ার আশায় এমনই বিপদের খেলা ভিডিয়ো করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে গিয়ে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক বছরে। মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। এমনকি, একাধিক অপরাধ বৈঠকে মারণ ভিডিয়ো গেমের পাশাপাশি এই ধরনের বিপজ্জনক ভিডিয়ো তোলার প্রবণতা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কখনওই তাতে লাগাম টানা যায়নি।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘অনেকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুলিশ কী করবে? এর জন্য কমবয়সিদের একাংশের হঠকারিতা দায়ী। এমন হঠকারিতার জন্য যদি বাহবা পাওয়া যায় তা হলে তো হয়েই গেল! তখন কোথায় থামতে হয় সেই বিবেচনা বোধটাই হারিয়ে যায়।’’
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় আবার বললেন, ‘‘এখন নতুন চল হয়েছে যে কোনও মূল্যে ভাইরাল হতে হবে। ভাইরাল হতে পারলে টাকাও পাওয়া যায়। টাকা আর জনপ্রিয়তার লোভেই ঝুঁকির ভিডিয়ো উঠছে। এ সবের মধ্যে কোথাও বিপদের কথাটাই মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলেদেরও তেমনই হয়েছিল বলে আমার মনে হয়।’’
সাইবার বিশেষজ্ঞ তথা ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত জানালেন, ভিডিয়ো করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে দিতে পারলেই টাকা। ভিডিয়ো দিয়ে ‘লাইক’ পেলে প্রচার বাড়ে। ধরা হয়, যাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পেজের যত লাইক, তাঁর ভিডিয়োর দর্শকও তত বেশি। যেখানে দর্শক বেশি, সেখানে বিজ্ঞাপন দেয় সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলি। দর্শক বিজ্ঞাপন দেখলে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা যে টাকা বিজ্ঞাপনদাতার থেকে আয় করে, তার ভাগ দেয় ভিডিয়োর মালিককে। সন্দীপবাবু বলেন, ‘‘বাড়তি লাইকের মোহে অভিনব কিছু করার চেষ্টা করেন অনেকেই। তখনই তাঁরা বেছে নেন বিপজ্জনক ভিডিয়ো তোলার পথ। সেই পথ কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা জানা সত্ত্বেও!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy