ত্রিবর্ণ: জাতীয় পতাকা নিয়ে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধী মিছিলে শামিল বিক্ষোভকারীরা। রবিবার, ধর্মতলার সমাবেশে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে গাড়িটার মাথায় দৃপ্ত ভঙ্গিতে জাতীয় পতাকা মেলে ধরলেন সদ্য তরুণ। তাঁর দু’পাশে ঠিক তখনই কারও হাতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কারও হাতে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধো মুর্মু এবং আশফাকুল্লাহ খানের ছবি। রবিবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ-এর সমাবেশ, শনিবার শহিদ মিনার থেকে ছাত্রদের পদযাত্রা কিংবা তারও আগে গত বৃহস্পতিবার পার্ক সার্কাস রামলীলা ময়দান থেকে মহামিছিল— মূল সুর যেন এটাই। অন্য রকম এক জাতীয়তাবোধের তেরঙা বিস্ফোরণ।
‘‘ঠিক কয়েক মাস আগেই জাতীয় পতাকা নিয়ে আর একটা মিছিলের কথা মনে আছে? ‘ভারতমাতা কি জয়’ হুঙ্কার দিয়ে লোকজনকে খামোখা ধমক দেওয়া, উস্কানি ছড়ানো নিশ্চয়ই ভোলেননি! আমাদের মিছিল সেই জাতীয় পতাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইটাই শুরু করে দিল।’’— রবিবার দুপুরে বলছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, বর্ধমানের জয়দীপ ঘোষ। গার্ডেনরিচের প্রাথমিক স্কুল-শিক্ষক কাসিফ জব্বরের কাছেও অন্য আবেগ জাতীয় পতাকায়। হেসে বললেন, ‘‘আর কত বার, কত ভাবে মুসলিমদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা নেবে এই সরকার! সবাইকে নিয়ে থাকার বা বাঁচার যে ভারতের কথা বলতে চাই, সেটা তো জাতীয় পতাকার তিনটি রঙেই সব চেয়ে ভাল ভাবে বোঝানো সম্ভব।’’ মধ্য তিরিশের কাসিফ, মেটিয়াবুরুজের দোকানদার আতিক রহমান, কলেজপড়ুয়া সৈয়দ রইস আহমেদরাও পরপর মিছিলে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরছেন।
বছর শেষের বিভিন্ন মিছিলের জন্য উৎসবের মেজাজেই প্রস্তুতি চলেছে থানার পাশে যাদবপুরের মেন হস্টেলে। মুর্শিদাবাদের ছেলে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রাজিবুল ইসলাম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহিদুল শেখ, ফুড টেকনোলজির পড়ুয়া পটনার অভয় রঞ্জন, ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া আসানসোলের গণেশ আগরওয়াল বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কল্লোল দত্ত— উৎসাহে কম যান না কেউ। বলছেন, ‘‘এই দুর্দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছাড়া কাদের দিকে চাইব?’’ তাড়াহুড়োয় ছবিগুলো কাউকে দিয়ে আঁকানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইন্টারনেট থেকে পাওয়া প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, আশফাকুল্লাহ, ভগৎ সিংহ, তিতুমির প্রমুখের ছবি স্ক্যান করিয়ে আকার বৃদ্ধি করানোর পরে তা মিছিলে মেলে ধরার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: সুস্থ ভারতের স্বপ্ন ৮৮-র ‘যুবকের’
সচরাচর বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছেলেমেয়েদের মিছিলে লাল পতাকাই দেখা যায়। তবু এ বার জাতীয় পতাকা নিয়ে হেঁটে গর্বিত যাদবপুরে উইমেন্স স্টাডিজ়ের গবেষক প্রিয়স্মিতা দাশগুপ্ত। বলছিলেন, ‘‘এনআরসি বা নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা তো বিজেপির চাপিয়ে দেওয়া ভারতবর্ষের ধারণাটারও বিরোধিতা। বহুত্বের ভারতের কথা বলতেই জাতীয় পতাকা হাতে নিয়েছি। তা ছাড়া, জাতীয় পতাকা তো কোনও একটি দল বা মতের কারও পিতৃপুরুষের সম্পত্তি নয়!’’
তেরঙা নিয়ে এই অন্য আবেগ চোখে পড়েছে প্রাক্তন আমলা তথা ইতিহাসবিদ জহর সরকারের। তিনি হাসছেন, ‘‘শুধু জাতীয় পতাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া নয়। জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীতের অধিকার যারা আত্মসাৎ করেছিল, এটা তাদের পাল্টা প্রশ্ন করাও হল।’’ জহরবাবু মনে করাচ্ছেন, ’৪৭-এর দেশভাগের আগে আরএসএসের মুখপত্রে কী ভাবে তেরঙা নিয়ে আপত্তির কথাই বলা হয়েছিল। তেরঙা পতাকা অশুভ বলে ভাগওয়া (গেরুয়া) ঝান্ডার কথা বলত তারা। গাঁধী হত্যার পরে বছর দেড়েক নিষিদ্ধ ছিল সঙ্ঘ। এর পরে সর্দার পটেলের কাছে কার্যত মুচলেকা দিয়ে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি আনুগত্যের কথা বলে তারা।
আরও পড়ুন: বেড়াতে এসে বিক্ষোভে শামিল মার্কিন অধ্যাপকও
প্রেমে-প্রতিবাদে মেশা ডিসেম্বরের কলকাতায় এ দিন দেখা গিয়েছে, জাতীয় পতাকা হাতে হাসিতে কলকলিয়ে উঠছেন মেহেদিবাগান, রাজাবাগানের কলেজছাত্রীরা। নিউ মার্কেটের জটলায় ‘হম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি’ স্লোগানের পাশেই কোরাস গেয়েছে, ‘সারে জঁহাসে অচ্ছা’ বা ‘সকল দেশের রানি’! মিছিল দেখে উদ্বেল এক প্রবীণের কথায়, ‘‘দেশপ্রেমের নামে আজকাল দ্বেষপ্রেমটাই চলে বেশি! অনেক দিন বাদে জাতীয় পতাকা দেশকে ভালবাসাই উস্কে দিচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy