গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মনোজ বর্মাকে প্রথম দেখেছিলাম ২০০৯ সালে। তখন তিনি অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী। তখন তৃণমূলে মুকুল-যুগ। সেই ‘তৃণমুকুল’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেখানে সভা করবেন, তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই একই মাঠে সভা করবেন তৃণমূলনেত্রী মমতা। সেই সূত্র মেনেই মমতা সভা করতে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে।
সভামঞ্চের পাশের একটা চেয়ারে বসেছিলেন তৎকালীন বাম সরকারের ‘আস্থাভাজন’ তথা মাওবাদী দমনে গঠিত ‘এসটিএফ’-এর অন্যতম অফিসার মনোজ। পরনে জংলাছাপ ‘ক্যামোফ্লাজ়’ উর্দি। কোমরে নাইন এমএম পিস্তল। কোলে শোয়ানো রয়েছে একে ফর্টি সেভেন রাইফেল। আলাপ করতে যাওয়ায় ঠোঁটচাপা একটা হাসি হেসেছিলেন শুধু। সে হাসিতে কোনও গলে-পড়া ভাব ছিল না। সে হাসি আপাদমস্তক ‘পুলিশি’।
মনোজ বর্মা আদতেও তা-ই। মাথার ‘বেরে’ টুপি থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত পুলিশ!
মঙ্গলবার বিনীত গোয়েলের জায়গায় তাঁর নাম কলকাতা পুলিশের কমিশনার পদে ঘোষণা হওয়ার পর এক বিদগ্ধ সহ-নাগরিক বার্তা পাঠালেন, ‘‘মনোজ?!’’ জবাবে জানালাম, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী কিশোর উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র কথা মনে পড়ছে। বিবাদী বাগের অদূরে কলকাতা পুলিশের সদর দফতর ‘লালবাজার’ তো এখন তা-ই। সেখানে সব এলোমেলো হয়ে আছে। তফাত হল, এ কোনও কিশোর উপন্যাস নয়। থ্রিলার। সহ-নাগরিক ভিন্নমত হননি।
একই মত পোষণ করছেন কলকাতা পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন পদে-থাকা বিভিন্ন স্তরের কর্মী এবং অফিসারেরা। তাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য, এই ‘সঙ্কটসময়ে’ মনোজের চেয়ে দক্ষ অফিসার সম্ভবত পেতেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা পুলিশ-সহ রাজ্যের পুলিশবাহিনীর প্রতি আক্রোশ যখন আরজি কর-কাণ্ডে ফেটে পড়ছে, বাহিনীর মনোবল যখন তলানিতে, তখন এমন এক আপাদমস্তক পুলিশকর্তারই প্রয়োজন ছিল। যিনি পুলিশি পরিভাষায় ‘কোর পুলিসিং’ করতে দক্ষ। যিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আগ্রাসী নন। আবার মিনমিনেও নন। যিনি পুলিশ হয়ে পুলিশের কাজটা করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, যিনি অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা রাখেন। মনোজের সঙ্গে একদা কাজ-করা এক প্রাক্তন অফিসারের কথায়, ‘‘উনি আসুরিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা রাখেন। যে কোনও কনস্টেবলের চেয়েও বেশি। দিনে আঠাশ ঘণ্টা কাজ করার মানসিকতা রাখেন। অসমসাহসী!’’
দুই পুত্রসন্তানের (দু’জনেই দিল্লি টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির কৃতী ছাত্র। অধুনা চাকুরিরত। স্ত্রী সারদা গৃহবধূ) জনক অধুনা ৫৬ বছর বয়সি মনোজের অসম সাহসের গল্প পুলিশবাহিনীতে ঘোরে। তার মধ্যে কিছু সত্যি। কিছু ‘মিথ’। যেমন দার্জিলিংয়ের সিপচুতে বিমল গুরুংয়ের বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চোয়াল ভেঙে যাওয়ার পরেও ঘটনাস্থল থেকে সরে না-গিয়ে ভাঙা চোয়াল নিয়েই লড়ে যাওয়া। যেমন কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশে থাকাকালীন এক ‘বিপন্ন’ ব্যবসায়ীর তাঁকে ‘উপঢৌকন’ দিতে আসা এবং মনোজের তাঁকে সটান ঘাড়ধাক্কা দিয়ে লক-আপে ভরে দেওয়া। সঙ্গে ধমক, ‘‘কোথায় কী বলছেন জানেন না? কী ভেবেছেন? সব কিছু টাকা দিয়ে কিনে নেবেন?’’ প্রথম ঘটনাটির সাক্ষী আছেন অনেকে। দ্বিতীয় ঘটনাটির সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি বটে। কিন্তু মনোজের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিতেরা বলছেন, এ ঘটনা ঘটে থাকা একেবারে অসম্ভব নয়।
অবিভক্ত মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার থাকার সময় মাসে অন্তত ২২ দিন নাইট ডিউটি করতেন। রাজ্য পুলিশের এক পদস্থ অফিসার এখনও লালগড় অপারেশনের সময়কার কথা মনে করতে পারেন। অবসরপ্রাপ্ত সেই অফিসারের কথায়, ‘‘ওই অপারেশনের সময় দুটো দিক দিয়ে ঢুকেছিলাম আমরা। একটা গোয়ালতোড় দিয়ে ঢুকে কাদাশোল, রামগড় হয়ে কাঁটাপাহাড়ি। সেই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্ধিনাথ গুপ্ত। আর একটা বাহিনী প্রবীণ কুমারের নেতৃত্বে ভুলাভেদা হয়ে কাঁটাপাহাড়ি পৌঁছেছিল। মনোজ প্রথমে সিদ্ধিনাথের বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদী এলাকা দখল (ডমিনেট) করতে করতে কাঁটাপাহাড়ি গিয়েছিল। সেখানে ক্যাম্প তৈরি করে আবার ফিরে গিয়েছিল দ্বিতীয় বাহিনীর কাছে। তাদের সঙ্গে আবার অন্য পথে কাঁটাপাহাড়ি এসেছিল। আমরা ওর পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম!’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক এখনও মনে করতে পারেন ২০২৩ সালের গঙ্গাসাগরের কথা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সাগরমেলার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন মনোজ। সারা দিন ডিউটি করার পরে খবর পেয়েছিলেন, সাগরের চড়ায় একটি ‘ভেসেল’ আটকে গিয়েছে। সেই রাতেই হোভারক্রাফ্ট নিয়ে ছুটেছিলেন আটক জলযানের যাত্রীদের উদ্ধার করতে। চড়া থেকে সমস্ত যাত্রীকে উদ্ধার করে যখন সাগরদ্বীপে নিজের অস্থায়ী আস্তানায় ফিরেছিলেন, তখন রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে।
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে প্রায় দু’বছর ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ ছিলেন মনোজ। কিন্তু আলস্য করে সময় কাটাননি। রোজ ঘড়ি ধরে অফিসে গিয়েছেন। সারা দিন অফিসে থেকেছেন। সে কথা বলতে গিয়ে তাঁর তখনকার এক অধস্তন বলছিলেন, ‘‘ওই দু’বছরে এক দিনও ছুটি নেননি। এতটাই মনের জোর মনোজ স্যরের। এতটাই শৃঙ্খলার বোধ তাঁর।’’ তিনিই বলছিলেন, ‘‘বিনীত স্যর ভাল মানুষ। সৎ। কিন্তু একটু রগচটা। একটু একগুঁয়ে। উনি যখনই যেখানে থেকেছেন, সহকর্মীরা ওঁকে নিয়ে একটু বিরক্ত হয়েছেন। মনোজ স্যর টিমম্যান। উনি সারা দিনরাত নিজে কাজ করবেন। কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না। তখন লোকে লজ্জা পেয়ে ওঁর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে দেবে!’’
একটা সময়ে মনোজকে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার করেছিলেন মমতা। তখন শিল্পাঞ্চলে প্রায় রোজ গোলমাল। নৈহাটি, ভাটপাড়া-সহ বিভিন্ন এলাকা অশান্ত। চলছে গুলির লড়াই। লোকশ্রুতি: মনোজই ‘ঠান্ডা’ করেছিলেন ‘ডাকাবুকো’ অর্জুন সিংহকে। শিল্পাঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হাল ফেরে। এবং তার পরেই নাকি ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদও তৃণমূলে ফেরেন।
রাঢ়বাংলার মাওবাদী দমন অভিযানে সক্রিয় থেকেছেন। উত্তরের পাহাড় সামলেছিলেন। দক্ষিণের শিল্পাঞ্চলও। অর্থাৎ, যেখানে সমস্যা, সেখানেই মনোজে ভরসা রেখেছেন শাসক। সে বাম আমল হোক বা অবাম। কিন্তু কলকাতা পুলিশকে বর্তমান সঙ্কট থেকে কি টেনে তুলতে পারবেন মনোজ?
পুলিশবাহিনীতে এর সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে জবাব নেই। এক অফিসারের কথায়, ‘‘ওঁর থেকে ভাল পুলিশ অফিসার এই রাজ্যে খুব কম আছেন। কিন্তু এমন এক অদ্ভুত সঙ্কটের সময়ে বাহিনীকে টেনে তোলা ওঁর পক্ষে কঠিন হতে পারে।’’ কেন? ওই অফিসারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ‘‘প্রথমত, উনি একজন অসম্ভব দক্ষ পুলিশ অফিসার। বাট হি ইজ় অ্যান এক্সেলেন্ট স্পেশ্যাল পুলিশ কমিশনার। বিশেষ পুলিশ কমিশনারের পদে উনি অসম্ভব সফল হবেন। কিন্তু পুলিশ কমিশনার হতে গেলে এর সঙ্গে আরও কিছু থাকতে হয়।’’ কী থাকতে হয়, সে সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘একটা হল সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক। দ্বিতীয়টা হল একই সঙ্গে অনেকগুলো শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। প্রথমটা এই সময়ে আরও বেশি দরকার। কিন্তু উনি কথা কম বলেন। সেই কারণে মিডিয়ার সঙ্গে সেই ধরনের সম্পর্ক নেই। হয়তো ব্যক্তিগত স্তরে পূর্বপরিচিত কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক ভাল। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ওঁর সেই সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত, উনি আপাদমস্তক ফোর্সের লোক। তাই কূটনীতিক নন। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তেমনই বলে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার হতে গেলে কর্মদক্ষতার পাশাপাশি একটু কূটনীতিও প্রয়োজন। এমন একটা সময়ে তো সেটা আরও বেশি দরকার। কোন কাজটা অবিলম্বে করতে হবে আর কোনটা রয়েসয়ে করলেও চলবে, সেই বিচারটা খুব জরুরি।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘ওঁর মধ্যে কূটনৈতিক পারদর্শিতাটা একটু কম ছিল। আমি অন্তত দেখিনি। তবে সময়ের সঙ্গে যদি আয়ত্ত করে থাকেন তো ভাল।’’
অতীতে মনোজের সঙ্গে একই বাহিনীতে কর্মরত এক মাঝারি স্তরের অফিসারও একমত, ‘‘মনোজ স্যর হলেন ডিরেক্টর্স অ্যাক্টর। পরিচালক যেমন বলবেন, তেমনই করবেন। উনি ম্যাডামের ভরসার অফিসার। তিনি যা বলবেন, মনোজ স্যর সেটা করে দেবেন। এঁরা যে কোনও শাসকেরই আস্থাভাজন হন। কিন্তু কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে মাঝেমধ্যে পরিচালকের নির্দেশের অপেক্ষা না-করেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব সময় নমনীয় হলে চলবে না। তা হলে উনিও বিনীত স্যরের মতো সমস্যায় পড়ে যেতে পারেন।’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, গুরুংয়ের বাহিনীর সঙ্গে একদা ভাঙা চোয়াল নিয়ে লড়ে গিয়েছিলেন। এখন ক্রুদ্ধ জনতার অনাস্থার ঘায়ে কলকাতা পুলিশের চোয়াল ভেঙে গিয়েছে। সময় কঠিন। তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীরা মনে করেন, মনোজ তবু লড়ে যাবেন। যদি ‘বর্মা’ থেকে ‘শর্মা’ হওয়া যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy