সে কবেকার কথা! ঘরে-ঘরে রেডিয়ো পৌঁছয়নি তখনও। দোতলার বারান্দায় নিজের তৈরি রেডিয়ো রেখে চোঙা বসিয়ে পড়শিদের মহিষাসুরমর্দিনী শোনাতেন তিনি। এখনও সে-সব দিনের কথা মনে পড়লে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা বছর ছিয়াত্তরের প্রভাতকুমার সরকারের। রেডিয়োর সঙ্গে ঘর তো আর কম দিনের হল না!
সেই ১৯৪০ সালে ফিলিপস কোম্পানির পাকা চাকরি ছেড়ে বিডন স্ট্রিটে বসতবাড়ির একতলায় ফার্স্ট বুকের লেখক শিক্ষাবিদ প্যারিচরণ সরকারের বংশধর পূর্ণেন্দুকুমার সরকার খুলে বসেছিলেন ‘সরকার রেডিয়ো সিন্ডিকেট’। মারফি, ফিলিপস, বুশ সংস্থার তৈরি রেডিয়ো মেরামতির পাশাপাশি নিজেই তৈরি করতেন এসি-ডিসি বিদ্যুতে ভাল্ভ সেটের রেডিয়ো। সাহেবপাড়ার ইংরেজরা ছিলেন তাঁর নিয়মিত খদ্দের। ছবি বিশ্বাস, অপরেশ লাহিড়ী-সহ আরও বহু নামী ব্যক্তিত্বের রেডিয়ো এ বাড়িতে রোগ সারাতে আসত। বাবা পূর্ণেন্দুকুমারের সেই ‘রেডিয়ো-ডাক্তারি’ই তার পর থেকে টেনে যাচ্ছেন প্রভাতকুমার। বয়স হলেও এখনও নিয়ম করে রবিবার বাদে দিনে চার ঘণ্টা দোকান খোলেন তিনি। মহালয়া এগিয়ে আসতে ব্যস্ততাও বেড়েছে প্রভাতকুমারের। বলছেন, ‘‘বছরের এই সময়টা দোকানে তবু একটু আনাগোনা হয় লোকের। না হলে অন্য সময় তো কেউই আসেন না। রেডিয়ো আর কে শোনেন!’’
সত্যিই রেডিয়োর-শ্রোতা সে অর্থে কোথায়! কিন্তু মহালয়ার সঙ্গে বাঙালির রেডিয়ো-শ্রবণের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, এত বছর পরেও হয়তো তা অটুট। কারণ, ১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর রেডিয়োয় ‘মহিষাসুর বধ’-এর শ্রবণ-অভিজ্ঞতা বাঙালির মহালয়ার ভোরকে পুরো পাল্টে দিয়েছিল। সে বছর অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা বুঝে ১৯৩৭ সালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে সম্প্রচার শুরু হয়। তার পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যাবতীয় সমালোচনা। এর আগে পর্যন্ত কায়স্থ সন্তানের চণ্ডীপাঠের যোগ্যতার প্রশ্নে বিদ্ধ হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

কুমোরটুলির সেই দোকানে পুরনো রেডিয়োর মডেল। নিজস্ব চিত্র
বঙ্গজীবনের সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ জুড়ে যাওয়ার সেই শুরু। সে বছরই বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (ছদ্মনাম বাণীকুমার) রক্ষণশীল সমাজের মুখে ঝামা ঘষে সম্প্রচারের সময় নির্দিষ্ট করেন মহালয়ার ভোর চারটে থেকে সকাল সাড়ে পাঁচটা। ২০১৯-এ এসেও যা একই রয়ে গিয়েছে। ১৯৩২ সালে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে যে বিশেষ বেতার অনুষ্ঠানের সম্প্রচার শুরু, সে বছর দুর্গাষষ্ঠীতে তা সামান্য বদলে ফের সম্প্রচার হয়। বারবার পরিমার্জিত হতে থাকে অনুষ্ঠানটি। বাণীকুমারের লেখায় জানা যায়, বসন্তেশ্বরী অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নাট্যকথাসূত্র ও গীতাংশ সংগ্রহ করেছিলেন। চণ্ডীপাঠ করেছিলেন বাণীকুমার। তবে ১৯৩৭ সালে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
এ ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠানে বেতারের আকর্ষণ যে বাড়ছিল, তার প্রমাণ একটি তথ্য। ভবেশ দাশ ও প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত ‘কলকাতা বেতার’ বইয়ে রয়েছে, দেশে ১৯৩২-এ বেতার গ্রাহক ছিলেন ৮,৫৫৭। ১৯৩৯-এ তা দাঁড়ায় ৯২,৭৮২। রেডিয়োর চাহিদা বাড়ছে বুঝেই শহরে বাড়তে থাকে মেরামতির ব্যবসা। উত্তর কলকাতা, খিদিরপুর-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় গজিয়ে ওঠে সারাইয়ের দোকান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য তার প্রায় সবই পাট চুকিয়েছে।
ষাটের দশকে কুমোরটুলির ভিতরে একটি রেডিয়ো সারাইয়ের দোকান হয়েছিল। কয়েক হাতের দোকানটি আজও ঠাসা থাকে রেডিয়োর সাবেক মডেলে। ১৯৪৪ সালের ফিলিপস হল্যান্ড চোখ টানে আলাদা করে। কুমোরটুলিতে ঠাকুরের বায়না নিয়ে আসা মানুষেরাই মূল খরিদ্দার। জানালেন দোকানমালিক অমিতরঞ্জন কর্মকার। কিন্তু ওইটুকুই! বাকি সময়ে পুরনো স্মৃতি ঘিরে থাকেন তিনি।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, আর এম চিনয় এবং সুলতান চিনয় নামে দুই পার্সি শিল্পপতি বেসরকারি উদ্যোগে ১৯২৩ সালে ‘ইন্ডিয়া রেডিয়ো টেলিগ্রাফ কোম্পানি’ খুলে শহরে যে বেতার যাত্রার সূচনা করেন, সেই পথেই ১৯৩৫ সালের অগস্টে
জন্ম নিল অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো। দেবীপক্ষের আহ্বানে অনন্ত সেই যাত্রাপথ। যদিও প্রভাতকুমার, অমিতরঞ্জনেরা জানেন না, সে পথে আর কত দিন হাঁটতে পারবেন তাঁরা!