পাশাপাশি: এই কোয়ার্টার্সেই থাকে দুই পরিবার। নিজস্ব চিত্র
টানা লড়াইয়ের পরে শেষমেশ হার মেনেছে রোগ। দেড় মাসের সেই যুদ্ধের পরে বাড়ি ফিরে এসে পড়শি পুলিশ আধিকারিক ও তাঁর পরিবারকে বার বার ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ‘কোভিড যোদ্ধা’ সাব ইনস্পেক্টর।
ব্রিটিশ আমলের টালির ছাউনির একই ছাদের তলায় পাশাপাশি দু’টি পরিবারের বাস। লম্বা বাড়ির একপাশে সপরিবার থাকেন একবালপুর থানার ওসি আমানুল্লাহ এবং অন্য দিকে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার সাব ইনস্পেক্টর সুবিমল বর্মা। দেড় মাস হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেছেন সুবিমলবাবু। তিনি একা নন, এই সময়ের মধ্যে তাঁর পরিবারের বাকি ন’জন সদস্যের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সাত জনই। গার্ডেনরিচ থানার কাছে ওই সরকারি আবাসনে সুবিমলবাবুর প্রতিবেশী বলতে আমানুল্লাহ ও তাঁর পরিবার। চারপাশ কার্যত জনমানবহীন। এই কঠিন সময়ে প্রতিবেশীর কাছ থেকে যে সাহায্য তাঁরা পেয়েছেন, তা কখনও ভুলতে পারবেন না বলে জানাচ্ছেন সুবিমলবাবু।
গত ৯ জুলাই প্রথমে সুবিমলবাবুর করোনা ধরা পড়ে। ওই দিনই তিনি ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। উপসর্গ না থাকায় ১৫ জুলাই ছেড়ে দেওয়া হয় সুবিমলবাবুকে। কিন্তু ১৭ তারিখ থেকে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ওই দিন তাঁকে প্রথমে এম আর বাঙুর হাসপাতাল এবং সেখান থেকে ১৯ তারিখে ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। এই দফায় তিনি ২৮ জুলাই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। ৪ অগস্ট থেকে ফের তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ৬ অগস্ট তাঁকে ই এম বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২২ অগস্ট কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরে বাড়ি ফিরে এলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি সুবিমলবাবু। মাঝেমধ্যেই কাশি হচ্ছে। বেশ দুর্বলও বোধ করছেন তিনি। এই পুরো সময়ের মধ্যে একে একে তাঁর স্ত্রী, ছোট ছেলে, মেয়ের করোনা পরীক্ষার রিপোর্টও পজ়িটিভ এসেছিল। আক্রান্ত হন সুবিমলবাবুর ভাইয়ের পরিবারের চার জনও। একে একে ওই সাত জনকে পাঠানো হয় কোয়রান্টিন কেন্দ্রে।
ফোনে সুবিমলবাবু বলেন, ‘‘করোনা আক্রান্ত ও তাঁদের পরিবারকে যখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চলছে চার দিকে, ঠিক তখনই আমানুল্লাহ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী দৃষ্টান্ত হয়ে উঠলেন।’’ দেড় মাসে সুবিমলবাবুর বাড়িতে একটানা ছিলেন তাঁর বড় ছেলে ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। বাকিরা কখনও বাড়িতে, কখনও কোয়রান্টিন কেন্দ্রে ছিলেন। সুবিমলবাবুর কথায়, ‘‘বাড়ির প্রায় সকলেই যখন একে একে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তখন একবালপুর থানার ওসি নিয়মিত ভরসা জুগিয়েছেন। ওঁরা পাশে থাকায় মনে জোর পাই। বাড়ির লোকেদের পরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ফোনে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা— সবই করেছেন ওঁরা। জীবনের এই কঠিন সময়ে এটাই বড় প্রাপ্তি।’’
সুবিমলবাবু আরও বলেন, ‘‘বাড়ির সদস্যদের বাইরে বেরোনোয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে জানলাম, নার্গিস ভাবী (আমানুল্লাহ সাহেবের স্ত্রী) বাড়িতে বিরিয়ানি থেকে শুরু করে নানা খাবার নিয়মিত পৌঁছে দিতেন। কাছেই আমানুল্লাহ সাহেবের শ্বশুরবাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে উনি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু আমাদের পাশে থাকার জন্যই স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের নিয়ে থেকে গিয়েছেন। ওঁদের হাজারো কুর্নিশ।’’
একবালপুর থানার ওসি আমানুল্লাহ বলছেন, ‘‘করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো প্রতিবেশীদের কর্তব্য। এটা সর্বদা মনে রাখা উচিত।’’ আর তাঁর সহধর্মিণী নার্গিস বেগম জানান, করোনা আক্রান্ত ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিবেশীদের অমানবিক আচরণের কথা সংবাদমাধ্যমে দেখেছেন। তাই সুবিমলবাবুর পরিবারের সদস্যদের করোনা হওয়ার খবর পেয়েই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। প্রতিবেশীর পাশে থাকবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy