খোদ মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাবড় পুলিশকর্তাদের সামনেই যা ঘটার ঘটেছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তাবড় পুলিশকর্তারা বিষয়টি উপভোগ করেছেন।
এর পরে আইন-কানুন-শাস্তির প্রসঙ্গ প্রত্যাশিত ভাবেই ওঠার কথা নয়। উঠলও না। শাহরুখের সঙ্গে উর্দি পরে নেচে তরুণী পুলিশকর্মী কোনও শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি বলেই রবিবার কার্যত ক্লিনচিট দিল লালবাজার। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (৩) দেবাশিস রায় দাবি করলেন, “এই ঘটনায় শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়েছে, সেটা কে বলল!”
বলছেন তো অনেকেই। তার মধ্যে বিরোধী নেতারা যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তারাও। এমনকী, লালবাজারের অন্দরে একাংশের মনেও এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশের বিনোদনী অনুষ্ঠান ‘জয় হে’-র মঞ্চে শাহরুখ খানের সঙ্গে তালে-তাল মিলিয়ে নেচেছিলেন কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল শম্পা হালদার। নাচের তালেই শাহরুখের কোলে পা তুলে দিয়েছিলেন তিনি, নায়কও পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছিলেন তাঁকে! তখন মঞ্চের সামনে দর্শকাসনের প্রথম সারিতে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ-সহ লালবাজারের শীর্ষ পুলিশকর্তারা। তাঁদের সামনেই উর্দি পরিহিত এক পুলিশকর্মীর এমন নাচের দৃশ্য দেখে প্রাক্তন ও বর্তমান পুলিশকর্তাদের অনেকেই বলছেন, এই ঘটনা উর্দির অপমান। এতে শাস্তির বিধানও আছে।
বছর দুয়েক আগে জলপাইগুড়ির টাউন হলে উর্দি পরে নেচে শো-কজের মুখে পড়তে হয়েছিল এক মহিলা পুলিশকর্মীকে। ২০০৩ সালে মুর্শিদাবাদে টলিউডের এক নায়িকার সঙ্গে উর্দি পরে নাচায় সাসপেন্ড হতে হয়েছিল এক সাব-ইনস্পেক্টরকে। তা হলে শনিবারের ঘটনায় শম্পাদেবী শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন বলে ধরা হবে না কেন? উর্দির এই অসম্মান মানতে পারছেন না কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “ছবিটা দেখে খারাপ লেগেছে। উর্দি-টুপি পরে থাকা মানেই কর্তব্যরত থাকা। তখন ডিউটি ছাড়া অন্য কিছু করা যায় না।’’ রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সখেদে বলছেন, “এ কোথায় চলে যাচ্ছি আমরা!”
অথচ রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য, “এর মধ্যে আমি খারাপ কিছু দেখি না। ওই পুলিশকর্মী কোনও আইনভঙ্গ করেছেন বলে আমার জানা নেই।”
কিন্তু কলকাতা পুলিশেরই একাংশ বলছেন, উর্দি পরে কী করা যায় এবং কী করা যায় না সবই পুলিশি আচরণবিধিতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। সাধারণত পুলিশের উর্দি পরে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, পানশালা, রেসের মাঠে যাওয়া যায় না। এমনকী, উর্দি পরে সিগারেট খাওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে।
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম অভিযোগ করছেন, “যে কোনও দেশেই উর্দির কিছু ‘কোড’ থাকে। কিন্তু তৃণমূলের জমানায় বিনোদন এত বড় একটা শিল্প যে, নিয়ম-নীতি-আদর্শ কোনও কিছুর পরোয়া নেই!” রাজ্য বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “এই সরকারটাই খেলা-মেলা-মোচ্ছবের সরকার। ‘ইউনিফর্ম সার্ভিস’ কী, সে সম্পর্কে এদের কোনও ধারণা আছে বলে মনে হয় না।”
লালবাজারের পুলিশকর্তাদেরও কেউ কেউ আড়ালে বলছেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী (যিনি আবার পুলিশমন্ত্রীও) এবং পুলিশ কমিশনারের সামনেই যদি এমন ঘটনা ঘটে, তা হলে কি শাস্তির আশা করা যায়? তরুণী পুলিশকর্মী হয়তো পরিস্থিতির গুরুত্ব না-বুঝেই একটা কাজ করে ফেলেছেন। কিন্তু তাঁকে যাঁরা এমন করতে প্রশ্রয় দিয়েছেন, অভিযোগের আঙুলটা সবার আগে তাঁদের দিকে ওঠা উচিত বলেই ওই কর্তাদের মত।
কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার নিরুপম সোম স্পষ্ট বলছেন, এই ঘটনায় ওই কনস্টেবল যত না দায়ী, তার চেয়েও বেশি দায়ী অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্তারা। কারণ, তাঁদের অনুমতি ছাড়া ওই কনস্টেবল মঞ্চে উঠে নাচতে পারেন না। নিরুপমবাবুর বক্তব্য, ওই তরুণী পুলিশকর্মী যে রকম সাবলীল ভঙ্গিতে নাচছিলেন, তা দেখে বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হয়েছে। স্বয়ং পুলিশ কমিশনার পুরো ঘটনাটি আগে থেকেই জানতেন বলেই তাঁর ধারণা। নিরুপমবাবু বলছেন, “আমার সময় হলে আমি এই ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতাম না।”
পুলিশ কমিশনারের ভূমিকা নিয়ে এমন প্রশ্ন ওঠার পরে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? প্রত্যাশিত ভাবে এ ক্ষেত্রেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন প্রশাসনের কর্তারা। রাতে রাজ্যের
মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “পরে ফোন করবেন।” স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় যথারীতি বলেন, “নো কমেন্টস।” পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ দিন ফোন ধরেননি। এসএমএস করেও উত্তর মেলেনি।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন, তাঁদেরও কার্যত হাত-পা বাঁধা। তৃণমূল জমানায় এই জাতীয় গণ-বিনোদনের ঢালাও সরকারি আয়োজন নিত্যনৈমিত্তিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাতে সক্রিয় ভাবে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েই হরেক আয়োজন হচ্ছে। শনিবার মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিনোদন-মঞ্চে উর্দিপরা বাহিনীর কর্মকাণ্ড দেখে তাঁর খুশি গোপন রাখেননি। অনুষ্ঠানের ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে লিখেছেন, “হৃদমাঝারে রাখিব গেয়ে এক পুলিশবন্ধু অনুষ্ঠানের মেজাজ তৈরি করে দিয়েছিলেন।” সাংসদ সেলিম কটাক্ষ করে বলছেন, “যে রাজ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে সঙ্গে নিয়ে নাচে পা (আইপিএল বিজয়োৎসব) মিলিয়েছেন, সেখানে পুলিশকে আর কী বলা যাবে?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মতে, উর্দি পরে নাচগানে প্রশ্রয় দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সংবিধানের অবমাননা করেছেন।
তবে পুলিশকর্তারা যে বিষয়টি নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া চান না, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ দিন ওই মহিলাকে আড়াল করার ঘটনাতেই। রবিবার সকালে খবরের কাগজে পুলিশকর্মীর নাচের ছবি দেখার পর থেকেই লালবাজারের অন্দরে গুঞ্জন শুরু হয়। শম্পা হালদার নামে ওই পুলিশকর্মী এ দিন ধর্মতলার ওয়াই রোডে ডিউটিতে ছিলেন। দুপুরেই কন্ট্রোল রুম মারফত শম্পাকে সদরে ডেকে পাঠানো হয়। তার পরে তিনি ব্যারাকে যান। সেখান থেকে কাউকে কিছু না বলেই তিনি বেরিয়ে যান বলে পুলিশ সূত্রের খবর। রাত পর্যন্ত তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল। তাঁর সহকর্মীরা জানান, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে শম্পাকে। বেশি রাতে তাঁকে ফোনে ধরা হলে, “এই নিয়ে কোনও কথা বলব না” বলে শম্পা ফোন কেটে দেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy