স্মৃতি: রামমোহন রায়ের বাড়িতে চলছে সাফাইকাজ। বুধবার, আমহার্স্ট স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র
সরাসরি বিদ্যাসাগরের মতো তাঁর উপরে আঘাত আসেনি এখনও। তবে তাঁর অবস্থাটাও খুব ‘নিরাপদ’ বলা যাচ্ছে কি?
শহর জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো তাঁর স্মৃতি ছুঁয়ে রাজা রামমোহন রায়ের ঐতিহ্যের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। রামমোহনের ২৪৮তম জন্মদিন ছিল বুধবার। সচরাচর রবীন্দ্রনাথের মতো রামমোহন-জয়ন্তী পালনের রীতি দেখা যায় না বাঙালির মধ্যে। তবু সম্প্রতি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ধ্বংসের সূত্র ধরেই এ বার নেটরাজ্যে জন্মদিনে রামমোহন-চর্চারও হিড়িক। ধর্ম নিয়ে এ দেশে যা গোঁড়ামি শুরু হয়েছে, তাতে রামমোহনের মতো ‘মুক্তমনা’ মানুষকে কত দূর সহ্য করা যেত, তা নিয়ে অনেকের মনেই আশঙ্কার কাঁটা।
এ দিন বিকেলে সাবেক আমহার্স্ট স্ট্রিটে (অধুনা রাজা রামমোহন সরণি) রামমোহনের স্মৃতিধন্য বসতবাড়ির সংগ্রহশালাতেও একই ধাঁচের আলোচনার সুর। রামমোহনের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ের তৈরি বাড়িটার লাগোয়া রামমোহন কলেজ। ১৮৩০-এ বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর মানিকতলার বাগান-বাড়ি বিক্রি করে দেন রামমোহন। শহর কলকাতায় সেই অর্থে এই বাড়িটাতেই তখন নিবিড় ভাবে মিশে রামমোহনের অস্তিত্ব। ‘সিমলা হাউস’ নামের সেই বাসভবনটি দু’দশক আগেও পড়ে ছিল নিতান্তই ভগ্নস্তূপের আদলে। স্থানীয় লোহালক্কড়ের কারবারিদের হাত থেকে বাড়িটা উদ্ধার করেন কয়েক জন রামমোহন-অনুরাগী। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক ও রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের অনুদানে কিছুটা হাল ফিরে এই বাড়িতেই গড়ে উঠেছে সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার অধিকর্তা তথা রামমোহন কলেজের অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা নন্দিতা দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের মূর্তি যারা ভাঙতে পারে, রামমোহন যে তাদের হাতে নিরাপদ থাকতেন, তেমনটা ঠিক ভাবা যাচ্ছে না।’’
১৮১৪-১৮৩০ প্রধানত মানিকতলার বাগানবাড়িতে থেকেছেন রামমোহন। পরে বিক্রি করে দেন বাড়িটি। সেখানে এখন কলকাতা পুলিশের মিউজ়িয়ম। স্মারক এবং আবক্ষ মূর্তি অবশ্য রামমোহনের স্মৃতি বহন করছে। ওই রাস্তারই উল্টো ফুটে অদূরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ গ্রন্থাগারের দোতলাতেও রামমোহন-স্মারক। রামমোহনের পাগড়ি, তাঁর কেশগুচ্ছ বা রোগশয্যায় তুলে নেওয়া তাঁর মুখের ছাঁচ— সবই সেখানে রাখা। গ্রন্থাগারের প্রাক্তন কর্তা তথা ইতিহাসবিদ শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আজকের ভারতেও বোধহয় নিঃসঙ্গই থাকতেন রামমোহন। হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীরা রামমোহনের প্রতিবাদ, বাড়াবাড়ি ভাল চোখে দেখতেন না।’’ রামমোহনের বাড়িতে সংগ্রহশালা গড়ার পর্বে খানিক জড়িয়ে ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব তথা ইতিহাসবিদ জহর সরকার। তিনিও বলছেন, ‘‘এ দেশের শাসক দল তো বিবেকানন্দ, নেতাজি— সকলের কথাকেই বিকৃত করে নিজেদের লোক বলে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। প্রথম আধুনিক ভারতীয় বলে পরিচিত রামমোহনের নামটা তাঁরা জেনেবুঝেই সচরাচর উচ্চারণ করেন না। বিদ্যাসাগরের মতো রামমোহনকে নিয়েও হিন্দুত্ববাদীদের অস্বস্তি থাকারই কথা!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম টেক পড়ুয়া অনিমেষ অধিকারী ঘটনাচক্রে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে বিদ্যাসাগরের বাড়ির কাছেই মেসবাসী। বিটেক ছাত্রী সঞ্চিতা মণ্ডল আবার আমহার্স্ট স্ট্রিটে হস্টেলে থাকেন। এ দিন বিকেলে তাঁরা দু’জনেও এসেছিলেন রামমোহনের বাড়ির সংগ্রহশালা দেখতে। ওঁরা বললেন, জন্মদিন কবে জানা ছিল না! জন্মদিনে রামমোহনের বাড়িতে চলে আসাটা কাকতালীয়। সঞ্চিতার স্বীকারোক্তি, ‘‘রামমোহনের বিষয়ে খুব যে আগে জানা ছিল, তা নয়! তবে রানি রাসমণি সিরিয়াল দেখতে দেখতে ওই সময়টা নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’’ সতীদাহ প্রথা রুখতে রামমোহনের লড়াইয়ে গল্পে উজ্জীবিত দু’জনেই। তাঁরা একমত, ‘‘ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রামমোহনের যা অবস্থান, তাতে এখনও রাজনীতির লোকেরা অনেকেই তাঁর উপরে খুব খুশি হতেন না।’’
রামমোহনের জেঠামশাই নিমানন্দ রায়ের উত্তরপুরুষদের সপ্তম প্রজন্ম দেবদীপ রায় এখন কাঁকুড়গাছিতে থাকেন। তাঁদের পারিবারিক সাংস্কৃতিক সংস্থার তরফেও জন্মদিন পালন করা হয়েছে। দেবদীপবাবু বলছিলেন, ‘‘রামমোহনের মধ্যে সব ক’টি ধর্মের চর্চা ও মিলমিশ ঘটেছে। ধর্ম নিয়ে যাঁরা ভাগাভাগি করেন, এমন মানুষ তাঁদের হয়তো অস্বস্তিতে ফেলতেন।’’ দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহনের লড়াই বা প্রাচীন ভারতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে রামমোহনের প্রবন্ধ তুলে ধরে নেটিজ়েনদের তর্কও সরগরম। রাজনীতির ‘জয় শ্রী রাম’-এর বাড়বাড়ন্তে এ দেশে রামমোহন-চর্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেকেই সন্দিহান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy