পরম্পরা: দুর্গা পিতুরির বাড়ির পুজো। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
ক’দিন আগেই শহরের বুকফাটা ধুলোর ধোঁয়া উড়ে এসেছিল বাড়িটার দিকে। যার তেতলায় বসে অশীতিপর প্রবীণ হারমোনিয়ামে চেনা সুর ভাঁজছেন। দ্বারিক মতিলাল বলছেন, ‘‘গলির মধ্যে যে ভাবে ধস নামতে শুরু করেছিল, তাতে কী ভাবে যে বেঁচে গেলাম, তা ভাবলে হয়তো মা দুর্গাকেই ধন্যবাদ দিতে হয়।’’
দুই শতক বা তার কাছাকাছি বয়সের দুর্গাপুজোটা এ বারও হচ্ছে বৌবাজারের অভিশপ্ত গলিতেই। কী ভাবে যে ঘটছে, পুজোর কর্মকর্তা মতিলাল-বাড়ির কর্তারাই ঠিক ভেবে উঠতে পারছেন না। সব থেকে প্রবীণ, ৮১ বছরের দ্বারিক মতিলাল কৃতজ্ঞ পাশের বাড়ির মুখোপাধ্যায় পরিবারের কাছে। ‘‘আমাদের শরিকি ঠাকুরদালান ওঁরা কিনে নিলেও পুজোর অনুমতিটুকু দিচ্ছেন। তাই এ গলির প্রাণপুরুষ দুর্গা পিতুরির পুজোটা বজায় রাখা গেল।’’ ধুলো-জমা জরাজীর্ণ ঠাকুরদালান ঘিরেই কলকাতার প্রাচীন জনপদের ইতিহাসের মায়া। পলাশির যুদ্ধের পরে তখন নতুন করে তাদের গড় ঢেলে সাজাচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আজকের ফোর্ট উইলিয়ামে, সেই দুর্গ গড়ার ঠিকাদার ছিলেন সে-কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাবু দুর্গা পিতুরি। গলির নামও তাঁর নামেই। দুর্গা পিতুরির ভাগ্নে বিশ্বনাথ মতিলাল কোম্পানির নুনের কারবারের দেওয়ান। সে যুগের ডাকসাইটে ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারটিই পুরনো ঠাকুরদালানে দুর্গা পিতুরির প্রতিষ্ঠিত পুজো বজায় রেখেছে। বৌবাজারের শিকড়ও এই মতিলাল-পিতুরিদের সঙ্গে জড়িয়ে। বিশ্বনাথ মতিলালের অন্যতম পুত্রবধূর নামেই বৌবাজারের প্রসিদ্ধি বলে শোনা যায়। তবে সেই বৌরানিটি কে, তা ঘিরে রয়েছে বিস্মৃতির ধোঁয়াশা।
পুজোর মাসখানেক আগে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে এই গলির নীচেই জেগে ওঠে শহরের মাটির নীচের দৈত্য। দুর্গা পিতুরি, সেকরাপাড়া লেনে বেশ কয়েকটি পরিবারই তার ফলে গৃহহারা, হোটেলে ‘আশ্রিত’। তবু কী ভাবে বেঁচে গিয়েছে, মতিলালেদের অধীনে থাকা কয়েকটি বাড়ি। ইতিহাসের গলিতে আশপাশে ভাঙাভাঙির দরুণ ঝুলনের সাজের জন্য বিখ্যাত বসাকদের বাড়ি থেকেও বাসিন্দাদের অন্যত্র সরানো হয়েছে। মতিলালেদের কিছু ডালপালা ছাড়া টিকে গুঁই, চৌধুরী, মল্লিক প্রমুখ।
সম্পর্কে জ্ঞাতি সোমনাথ মতিলাল, দেবকুমার মতিলাল বা পরের প্রজন্মের অর্ক মতিলালেরা ঠিক করেছেন, এ পুজোয় ঢাক বাজবে না। বদলে কাঁসর চলবে কিংবা ঢাকের সিডি বাজবে। মতিলালেদের মধ্যে প্রবীণতম দ্বারিকবাবুর আবছা শৈশব-স্মৃতি বলছে, একদা সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী মিলিয়ে ন’টি পাঁঠা বলি হত দুর্গাদালানে। সপ্তমীতে চিংড়ি, বিজয়া দশমীর মেনুতে ইলিশ ভাজা ছিল বাঁধা। এ বার সেই মেনুতেও কাটছাঁট হতে পারে!
পাশেই হিদারাম ব্যানার্জি লেনে দত্তদের পুজোর জৌলুসও কিছুটা ফিকে। পূর্বপুরুষের বেলজিয়াম কাচের ব্যবসার দরুণ বাড়িটা ‘বেলু-বাড়ি’ নামে পরিচিত। দুর্গা পিতুরি লেন, গৌর দে লেনে দত্তদের কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে। তা বেঁচে গিয়েছে বলে সামান্য নিশ্চিন্তি প্রবীণ শিশিরকুমার দত্তের কণ্ঠে। দুর্গা পিতুরি লেনে পুজোর সময়টা দ্বারিকবাবুরও যেন বসবাস সুদূর অতীতেই। সরু গলিতে দাদুর বক্স ফিটনের গর্জন, একসঙ্গে ভাসান দেখতে যাওয়ার গল্পে জমে উঠছে শারদ আবাহন। পঞ্চমীতে মা এসেছেন ঠাকুরদালানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy