Advertisement
১১ জানুয়ারি ২০২৫
Roxy Cinema Hall

রক্সিকে ঘিরে কি ফিরবে ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই

আগের লিজ়-মালিকদের আইনি যুদ্ধে হারিয়ে শতাব্দী-প্রাচীন বাড়িটির মালিকানা ফিরেছে কলকাতা পুরসভার হাতে।

যবনিকা: রূপান্তরের অপেক্ষায় শতাব্দী প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: সুদীপ ঘোষ

যবনিকা: রূপান্তরের অপেক্ষায় শতাব্দী প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: সুদীপ ঘোষ

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২০ ০৩:০৩
Share: Save:

শেষ বার রক্সিতে সিনেমা দেখানো বন্ধ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। মার্কিন সেনাদের থাকার বন্দোবস্ত হয় কলকাতার সাবেক স্থাপত্যঘরানার স্মারক অভিজাত প্রেক্ষাগৃহটিতে। গত বুধবার সিনেমা হলটিতে শেষ শো এক যুগাবসানের ঘোষণা করল।

আগের লিজ়-মালিকদের আইনি যুদ্ধে হারিয়ে শতাব্দী-প্রাচীন বাড়িটির মালিকানা ফিরেছে কলকাতা পুরসভার হাতে। সেই সঙ্গেই সাবেক স্থাপত্যশৈলী রক্ষার একটি জরুরি পদক্ষেপের আশা দেখছেন শহরের ঐতিহ্যপ্রেমীরা। কেন? বছর তিনেক আগে কলকাতার তৎকালীন মেয়রের জমানায় রক্সি ভাঙার উদ্দেশে হেরিটেজ গ্রেড টুএ থেকে থ্রি-তে নামিয়ে আনা হলেও ঐতিহ্যরক্ষাকর্মীদের প্রতিরোধে পিছু হটেন পুর কর্তৃপক্ষ। পুরসভার হেরিটেজ বিভাগের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার পার্থ সামন্ত শুক্রবার বলেন, ‘‘হেরিটেজ গ্রেড থ্রি থেকে রক্সিকে ফের গ্রেড টুএ করা হয়েছে। তাই ওই বাড়িতে পুরসভার অফিস করা হলেও পুরনো স্থাপত্য ভাঙার প্রশ্ন নেই।’’ অর্থাৎ রক্সির বাড়িটি পিছন দিকে বাড়ানো হতে পারে। তবে পুরসভার হেরিটেজ-বিধি মেনে, উপরে বাড়তি তলা তৈরি করা যাবে না। কলকাতার পুর কর্তৃপক্ষের হাতে ‘ধ্বংসলীলার’ রক্তাক্ত নমুনা রয়েছে রক্সির ঢিল ছোড়া দুরত্বে। যখন পুরসভার অফিস তৈরির উদ্দেশেই চ্যাপলিন সিনেমা হলটিকে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। ইতিহাসবিদ সৌমিত্র শ্রীমানি বলছিলেন, ‘‘চ্যাপলিন তৈরিই হয়েছিল, আমেরিকার পুরনো সিনেমা হলগুলির আদলে। অতি বিশিষ্ট সেই উপস্থিতিকেও ওরা মায়া করল না।’’

কলকাতার পুরনো অনেক সিনেমা হলেই রয়েছে বিশ শতকীয় স্থাপত্য-ঘরানা আর্ট ডেকোর ছায়া। অর্ধচন্দ্রাকার বারান্দা, লম্বাটে স্তম্ভের নকশা (ভার্টিকাল স্ট্রিপ), বাহারি গ্রিল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে যা একটি সময়ের চিহ্ন বহন করছে। একদা মেট্রো সিনেমা হলের আদলে এই ধরনের বাড়ি শহরের আমজনতার লব্জে ‘মেট্রোস্টাইল বাড়ি’ বলে চিহ্নিত হত। সেই মেট্রোর স্থাপত্যের কিছুটা অটুট রেখে শপিংমল হয়েছে। তবে হেরিটেজ স্থাপত্যবিদ তথা রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য পার্থরঞ্জন দাশ মেট্রোর এখনকার চেহারায় খুশি নন। তিনি বলছেন, ‘‘ওঁরা চাইলে আগের পুরো চেহারাই অটুট রাখতে পারতেন। ঢিলেঢালা নিয়মের ফাঁক গলে যা খুশি চলছে।’’ ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিক তথা কলকাতার ঐতিহ্যপ্রেমী অমিত চৌধুরীরও মত, ‘‘জিনিসটা ভাঙলাম না। কিন্তু চেনা যাচ্ছে না। এর মানে হয় না।’’ তবে অমিতবাবুর উদ্যোগে ঐতিহ্যরক্ষার মঞ্চ ক্যালকাটা আর্কিটেকচারাল লিগ্যাসিজ এবং ইনট্যাক মিলে এখন কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কিছু কাজ করছে। তাই অমিতবাবুর আশা, ‘‘আগে যা ঘটেছে, রক্সির ক্ষেত্রে তা হয়তো ঘটবে না।’’

তবে রক্সির পূর্বতন লিজ়মালিক বেঙ্গল প্রপার্টিজ প্রাইভেট লিমিটেডের অন্যতম ডিরেক্টর সুমিত সিংহের দাবি, ‘‘ঐতিহ্যরক্ষা এবং সিনেমার ব্যবসা একযোগে চালানো যেন উভয়সঙ্কট।’’ শতাব্দী-প্রাচীন সাবেক এম্পায়ার থিয়েটার ইউরোপের ধ্রুপদী অপেরার প্রদর্শনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সত্যজিৎ রায় সেখানেই উদয় শঙ্করের উপস্থাপনা মুগ্ধ হয়েছিলেন বলেও কিছু লেখালেখির সাক্ষ্য মেলে। সেই বাড়িই রক্সি সিনেমা হল। ১৯৪১ নাগাদ নিলামে লিজ়ের হাত বদল ঘটে। ১৯৪৩ থেকে তিন বছর রক্সিতে সুপারহিট অশোক কুমারের ‘কিসমত’। বিশ শতকের শেষেও অজস্র সফল বলিউডি ছবির স্বাদগন্ধে রমরম করত বাড়িটি। সুমিতবাবুর মতে, ‘‘সিনেমা হলের সেই দিন গিয়েছে। রকমারি অ্যাপে সিনেমা এখন ফোন-বন্দি। অনেকেই হলে যান না! মাল্টিপ্লেক্সকেও লড়তে হচ্ছে।’’ পুরনো লিজ়ের মেয়াদ ফুরোনোর পরে পুর কর্তৃপক্ষের দাবি মতো, বছরে সাত লক্ষ টাকা এবং ৭০ কোটি টাকার আসল (প্রিমিয়াম) মেটাতে পারেননি সুমিতবাবুরা। তাঁর কথায়, ‘‘মাল্টিপ্লেক্স করতে বাড়ির স্থাপত্য পাল্টানো যাবে না। আবার এত টাকা দিতে হবে। সেটা সম্ভব ছিল না। তাই আইনি যুদ্ধে হারের পরে দাবিও ছেড়ে দিচ্ছি।’’

গোটা কলকাতাতেই এখন ধুঁকছে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা। পরিবেশক-প্রযোজকদের সংগঠন ইম্পা-র এক কর্তা সরোজ মুখোপাধ্যায়ের হিসেব, সাকুল্যে ২০টি হল টিকে শহরে। পাশাপাশি, করোনার ভয়ে বলিউড ছবির মুক্তি বন্ধ রাখার সময়ে মিনার-বিজলি-ছবিঘর মেরামতির জন্য সপ্তাহখানেক হল বন্ধ থাকছে। ইম্পা-র কোষাধ্যক্ষ তথা পোড়খাওয়া সিনেমা হলমালিক শান্তনু রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘একটি অংশে শপিংমল করে রদবদল ছাড়া সিনেমা হল টেকানো মুশকিল।’’ হাতিবাগান-ভবানীপুর-ধর্মতলায় সিনেমা হল-সংস্কৃতি এখন না-থাকার মতো। অমিতবাবু অবশ্য মনে করেন, ‘‘হলের স্থাপত্য ও সিনেমা দেখানো দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরেই কয়েকটি সিনেমা হল তা পারছে।’’ রক্সিতে সিনেমা না-ফিরলেও বাড়ির ভিতর-বাইরের কিছু স্থাপত্য রীতিতে আপস চান না ঐতিহ্য বিশারদেরা। ১৯৬০-এর দশকে নিউ ইয়র্কের

রক্সি থিয়েটার রক্ষার লড়াই ঐতিহ্য রক্ষার যুদ্ধের চেহারা নিয়েছিল। কলকাতার রক্সি বাঁচানোর তাগিদ কি সেই প্রেরণা জোগাবে? আশায় কলকাতাপ্রেমীরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Roxy Cinema Hall KMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy