মণিপুরে আটকে থাকা স্বজনদের নিয়ে চিন্তায় (বাঁ দিক থেকে) এইচ মন্দাকিনী এবং থাংজাম নিরুপদা চানু। নিজস্ব চিত্র।
তাঁর বয়স পঁয়ষট্টির আশপাশে। আর পাঁচ জন প্রৌঢ়ের সঙ্গে তাঁকেও নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছিল সরকারি শিবিরে। কিন্তু সেখানে খাবার জুটছে না। নেই পর্যাপ্ত পানীয় জল। তার চেয়েও বড় কথা, প্রৌঢ়ের আশঙ্কা, পাহাড়ের কাছাকাছি তাঁদের ফাঁকা পড়ে থাকা বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে কী হবে! কারণ, ছেলেরা শিবির পাহারা দিতে গিয়েছে। বাড়ির মহিলা ও ছোটদের পাঠানো হয়েছে নিরাপদ আস্তানায়।
ভয় নিয়েই প্রৌঢ় ফিরেছিলেন বাড়িতে। দুপুরে দু’ঘণ্টা ঘরে কাটালেও নতুন চিন্তা পেয়ে বসেছিল, রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দিলে তো বেঘোরে পুড়ে মরতে হবে! তার চেয়ে বাড়ি এবং পাহাড়ের মাঝে যে পুকুর, সেখানেই রাতটা কাটানো ভাল! কিন্তু নিস্তার মেলেনি। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ পাহাড়ের ঢাল থেকেই হঠাৎ শুরু হয়েছে গুলিবর্ষণ। কোনও মতে ঝোপে লুকিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন প্রৌঢ়। বাবার এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে কলকাতায় থাকা মেয়ে থাংজাম নিরুপদা চানু বুধবার বললেন, ‘‘এটা গত রাতেরই ঘটনা। এই অবস্থায় বাবা-মা, আমার গোটা পরিবার মণিপুরে পড়ে রয়েছে! রাতে ঘুমোতে পারছি না।’’ একটু থেমে এর পরে বললেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে সীমান্তে সেনা বাড়িয়ে দিয়ে ঘরে থাকা যায়। কিন্তু গৃহযুদ্ধের সময়ে তা হয় না। কারণ, দু’পক্ষেরই ঘর পোড়ে।’’
চলতি মাসের ৬ তারিখ মণিপুরে নিজের শহরে যাওয়ার কথা ছিল চানুর। ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’-এর সঙ্গে যুক্ত এই তরুণী ছুটিও নিয়ে রেখেছিলেন। মা ও সদ্য স্কুলে ছুটি পড়া বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। নিজে এখন যেতে পারছেন না। পরিবারের কাউকেও ফিরিয়ে আনতে পারছেন না কলকাতায়। তাঁর অভিযোগ, তিন হাজার টাকার কলকাতার টিকিট ২০ হাজার দেখাচ্ছে। সেই টিকিটেও যে ফেরা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই!
হিংসা-বিধ্বস্ত মণিপুর থেকে সদ্য কলকাতায় ফেরা বৃদ্ধা মণিকা দেবী বললেন, ‘‘৩ মে সন্ধ্যায় টেলিভিশনে খবর দেখার পরেই ছুটেছিলাম জরুরি জিনিস কিনতে। হঠাৎ পুলিশের সাইরেন বাজানো গাড়ি ঘুরতে শুরু করল আশপাশে। কাছেই একটি বাড়িতে বোমা ফাটে। সে দিক থেকে ছুটে আসা লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিলেন কয়েক জন। ভয়ে এ দিক-ও দিক ছিটকে গিয়েছিলাম আমরা।’’ বৃদ্ধা আরও বলেন, ‘‘রাতটা এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। গোটা এলাকা অন্ধকার করে জেগে বসেছিলাম। পরদিন জানলা দিয়ে দেখি, একদল ছেলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জনজাতির নাম করে বলতে বলতে যাচ্ছে যে, ওঁদের পাহাড়ে ওঠার খুব শখ। এর পরে লাথি মেরে একটি বাড়ির দরজা খুলে এক তরুণীকে টেনে গাড়িতে তোলে তারা। মেয়েটির পরে কী অবস্থা হয়েছিল, জানা নেই। তিন দিনের মাথায় সেনার গাড়ি আমাদের উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।’’
একই বিমানে কলকাতায় ফেরা, মাঝবয়সি ভি জামিনা বললেন, ‘‘চোখের সামনে দেখেছি, বাচ্চা ছেলেদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আমাদের বাড়ি লুট হয়। আমার স্বামী কাজের সূত্রে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন। বাড়িতে হানা দিয়ে আমাদের পোষা কুকুরটাকে ছুরি মারে। আমাদের জনজাতির নাম করে বলতে শুনেছি, পেলে প্রথমেই গুলি করবি। গাড়ির নীচে লুকিয়ে বেঁচেছি আমি আর মেয়ে।’’ এইচ মন্দাকিনী নামে আর এক মহিলা বললেন, ‘‘আমার স্বামী ওখানে। দু’দিন অন্তর স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ। যারা হামলা করছে, তারা সর্বস্ব লুট করে নেওয়ার পরে হয় ধর্ষণ করছে, নয়তো জীবন্ত জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বিমানবন্দরে ক্যাথিটার ও রাইলস টিউব-সহ বহু মানুষ পড়ে রয়েছেন। কেন্দ্র কবে হস্তক্ষেপ করবে, জানি না।’’
কলকাতায় মণিপুরের বাসিন্দাদের সংগঠন ‘মণিপুরী ইন কলকাতা’র সহ-সভাপতি রোশন খুমুকচাম বলেন, ‘‘সংরক্ষণ নিয়ে এই লড়াই এক দিনের নয়। এক দল সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয় পাচ্ছে। অন্য দল বৈষম্য রোধে ও সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের জন্য সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছে। এ নিয়ে কেন্দ্র দীর্ঘদিন উদাসীন থেকেছে। এই দেশ নির্মীয়মাণ। উত্তর-পূর্বের সমস্যা না মেটালে কিন্তু দেশ নির্মাণের কাজ পুরোপুরি হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy