বদল: চাটুজ্জেদের রোয়াক এখন ঘেরা বারান্দা (বাঁ দিকে)। ছবি: শৌভিক দে
বাংলা সাহিত্যে তো তিনি অমর বটেই। উত্তর কলকাতার এক চিলতে গলিতেও তিনি ‘বেঁচে’ আছেন।
সময় গড়ালেও সাহিত্যে তাঁর বয়স বাড়েনি। আট থেকে আশি, তিনি সবার ‘দাদা’। কিন্তু পটলডাঙার বাসিন্দাদের কাছে তিনি আদরের ‘টেনিজেঠু’।
একদা ২০ নম্বর পটলডাঙা স্ট্রিটের বাসিন্দা ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। ছিপছিপে চেহারা, খাঁড়ার মতো নাক নিয়ে ছাপাখানার ব্যবসা সামলাতেন। ভাড়াটে ও সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কল্যাণে হয়ে গিয়েছেন ভজহরি ওরফে টেনি মুখুজ্জে। আর তাঁর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে রয়েছে পটলডাঙা স্ট্রিট, হাবুল, ক্যাবলা। রয়ে গিয়েছে ‘চাটুজ্জে’-দের রোয়াক।
আর পিলের রোগে ভোগা, পটল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাওয়া প্যালারাম?
সে-ই তো গল্পের কথক। লেখকের জবানি ফুটে উঠত তার মুখেই। কিন্তু কথকঠাকুর নিতান্তই চরিত্র হয়ে রয়ে গিয়েছেন। যেমন রয়ে গিয়েছে বাঙাল হাবুল সেন কিংবা পড়াশোনায় চৌখস ক্যাবলা। শোনা যায়, বাড়িওয়ালার দুই ভাইয়ের নাম নিয়েই ওই দুই চরিত্র। কিন্তু সব ছাপিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে তাঁরা সবাই নস্যি!
এ বছর টেনিদার স্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ। ১৯১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত দিনাজপুরে জন্মেছিলেন তিনি। পিতৃদত্ত নাম ছিল তারকনাথ। কিন্তু সাহিত্যজগতে তিনি নারায়ণ। লেখাপ়ড়ার পাঠ চুকিয়ে অধ্যাপনায় প্রবেশ। পটলডাঙায় থাকতে এসে জন্ম দিলেন ভজহরি ওরফে ‘টেনি’-র।
এত বছরে অনেক বদলে গিয়েছে পটলডাঙা। প্রভাতবাবুর মৃত্যুর পরে সেই বাড়িও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। পুরনো বাসিন্দাদের অনেকেই পাড়া ছে়ড়েছেন। গল্পের রোয়াক এখন লোহার খাঁচার জালে হয়েছে বারান্দা। নারায়ণবাবুর স্মৃতি শুধু সাহিত্যিক হিসেবেই। কিন্তু এত বছর পরেও রয়ে গিয়েছেন ‘টেনি’ এবং তাঁর স্মৃতি। গল্প এবং বাস্তব— মিলেমিশে একাকার সেখানে।
পটলডাঙার ওই গলির পুরনো বাসিন্দাদের অনেকের কাছেই তাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও ‘টেনিজেঠু’ কার্যত সমার্থক। লেখককে দেখার সৌভাগ্য হয়নি অনেকেরই। কিন্তু ‘জেঠু’-কে তো দেখেছেন। মনে আছে, কচি থেকে বুড়ো, সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। বিকেল হলেই রোয়াকে ফল খেতে খেতে জু়ড়তেন আড্ডা। পটলডাঙার পুরনো বাসিন্দা মানস সিংহ বলছেন, ‘‘ওই রোয়াক ছিল প্রভাতবাবুদেরই শরিকি বাড়ির। কিন্তু গল্পকার ‘মুখুজ্জে’-র বদলে ‘চাটুজ্জে’ করে দিয়েছিলেন।’’
প্রভাতবাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটলে যে বাড়িতে এসে ধাক্কা খাবেন, সেটাই সুব্রত দত্তের। ছোটবেলায় ‘জেঠু’-কে দেখেছেন। বলছিলেন, ‘‘আমরা তো সাহিত্যের চরিত্র হিসেবে দেখিনি ওঁকে। বন্ধুর মতো মিশতেন। কত যে গল্প বলতেন! গলি থেকে যাতে যখন-তখন না বেরোই তার জন্য ছেলেধরার ভয়ও দেখাতেন।’’
এই গল্প বলতে গিয়েই তো শুরু হয়েছিল ‘গল্প’! নারায়ণবাবুকে এক দিন রোগা চেহারা নিয়ে বিরাট ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প বলেছিলেন প্রভাতবাবু। ঠাট্টা করে ভাড়াটে বলেছিলেন, ‘‘তার পর ওই রোগা চেহারায় ঘুড়ির সঙ্গে নিজেও উড়ে গেলেন তো!’’ সেই গল্পই পরে হয়ে গেল ‘ঢাউস’! গল্পের টেনিদা ভূত শুনলেই মুচ্ছো যেত। আসল টেনিদার মুখে ভূতের গল্পে কিন্তু আসর জমত।
এক সাক্ষাৎকারে প্রভাতবাবু জানিয়েছিলেন, টেনিদার খ্যাতি তাঁকে বিস্তর বয়ে বেড়াতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে বিস্তর হাসিঠাট্টাও হয়েছে। কিন্তু রসিক মানুষটি কোনও দিন বিব্রত হননি।
ক্যাবলা চরিত্রটি যাঁকে নিয়ে, সেই সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছেলে তপন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বড়জেঠুর অসামান্য রসবোধ ছিল। কিন্তু ভাঁড়ামো করতেন না। একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব ছিল ওঁর। নানা বিষয়ে পড়াশোনা ছিল। প্রচুর গল্প বলতেন।’’ তিনি এ-ও বলছেন, তাঁর নাম ধরে চরিত্র তৈরি হলেও কল্পনা মিশিয়েছিলেন লেখক।
এটাই তো ‘টেনিদা’র ইউএসপি! বাস্তব, কল্পনা, লেখক, চরিত্র—সব মিশে পটলডাঙা স্ট্রিট তাই
স্মৃতির সরণি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy