টিভির পর্দায় যখন প্রথম তাঁকে দেখা গিয়েছিল, তাঁর মুখ ছিল ঢাকা। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই ঢাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন সুজেট জর্ডন। স্ব-নামে, স্ব-মূর্তিতে সর্বসমক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি বলে দিতেন, আমিই সুজেট। পার্ক স্ট্রিটে গণধর্ষিতা।
সাহস আর প্রতিবাদের মুখ সেই সুজেট তাঁর লড়াই অসম্পূর্ণ রেখেই প্রয়াত হলেন মাত্র ৪২ বছর বয়সে। তাঁর পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে, জ্বর আর খচুনি নিয়ে কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ভর্তি ছিলেন তিনি। শুক্রবার ভোর তিনটে নাগাদ মারা যান। হাসপাতাল জানিয়েছে, মেনিঙ্গো এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। গত সাত দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন সুজেট। প্রথম তাঁকে পার্ক সার্কাস এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেখানে অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁকে রেফার করা হয় ট্রপিক্যালে। চিকিৎসকেরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে বারোটার পর তাঁর অবস্থার ফের অবনতি হয়।
তবে পারিবারিক শোকতাপের বাইরেও এ দিন সমাজের নানা স্তরে বহু মানুষই আক্ষেপ করেছেন, পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ মামলার পরিণতি সুজেটের দেখে যাওয়া হল না। এই মুহূর্তে মামলার শুনানির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে এই তিন বছরেও মূল অভিযুক্ত কাদের খান অধরাই থেকে গিয়েছে।
২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। পার্ক স্ট্রিটের এক পানশালায় সুজেটের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিল কাদের আর তার বন্ধুরা। ফেরার সময় বিশ্বাস করে তাদের গাড়িতে উঠেছিলেন সুজেট। অভিযোগ চলন্ত গাড়িতেই তাঁকে ধর্ষণ করে কাদের। বাকিরা মদত জোগায়। রবীন্দ্র সদনের কাছে সুজেটকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
একটু ধাতস্থ হয়ে পুলিশের কাছে যেতে দু-তিন দিন সময় নিয়েছিলেন সুজেট। তিনি জানতেন না, তাঁর লড়াই সবে শুরু হয়েছে মাত্র। পুলিশ থেকে শাসক দল থেকে শাসক দলের মহিলা সাংসদ সুজেটের চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি কেউই। অভিযোগ, এফআইএর করতে যাওয়ার সময় পুলিশ শুধু তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহারই করেনি, তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা করানোর ব্যাপারেও যথেষ্ট গড়িমসি করেছিল তারা।
ঘটনাটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হওয়ার পরে ছবিটা বদলায়, নতুন করে জটিলও হয়। পরিবর্তনের সরকারের এক বছরও পূর্ণ হয়নি তখন। কলকাতা শহরের বুকে এমন ঘটনা নিয়ে হইচই শুরু হতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, এ সবই সাজানো ঘটনা। সুজেট নিজে প্রথমে ভুল লোককে অভিযুক্ত বলে শনাক্ত করায় বিতর্ক আরও বাড়ে। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথম বার দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেন, ধর্ষণ হয়েছে। দময়ন্তীর তৎপরতাতেই আসল অভিযুক্তেরা চিহ্নিত হয়। নাসির খান, রুমান খান এবং সুমিত বজাজ নামে তিন যুবককে গ্রেফতার করে লালবাজারের গোয়েন্দা শাখা।
দময়ন্তীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তখন বাঘিনির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সুজেট। এর পরপরই দময়ন্তীকে বদলি করে দেওয়া হয়। অন্য দিকে নানা হুমকি-শাসানি-প্রলোভনের টোপ উপেক্ষা করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থেকে যান সুজেট। বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা, দুই মেয়ের মা, আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। তার উপরে এত বড় ঘটনার ধাক্কা। সমাজ-সংস্কার-সরকার তাঁর চরিত্র নিয়ে নানা সময় নানা কথা বলেছে। সুজেট কিন্তু আপস-রফার পথ ধরেননি।
শুধু তাই নয়, যত দিন এগিয়েছে সুজেট যেন নতুন শক্তি নিয়ে নতুন মানুষ হয়ে উঠেছেন। ধর্ষণের ‘শিকার’ হয়ে থাকেননি, মুখ লুকিয়ে বাঁচেননি। বরং ধর্ষণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লড়াইয়ে নিজেকে সামিল করে নিয়েছেন। কামদুনিই হোক বা নির্ভয়ার ঘটনা সুজেট রাজপথে মিছিলে হেঁটেছেন। নানা প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে লাগাতার মুখ খুলেছেন। ধর্ষিতার জন্য নির্ধারিত আড়াল ভেঙে সুজেট জর্ডন হয়ে সামনে এসেছেন। সঙ্কোচের সমস্ত বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠেছেন।
সুজেটের এই সাহসকে কুর্নিশ জানিয়েছিল গোটা দেশ। আমির খান তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর রিয়েলিটি শো-এ। এ দিন সুজেটের মৃত্যুর খবর শুনে টুইটারে আরও এক বার তাঁকে সেলাম জানিয়েছেন তিনি। সুজেটকে নিজেদের পত্রিকার অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন সাংবাদিক তরুণ তেজপাল। পরে খোদ তরুণের বিরুদ্ধেই যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনেন এক তরুণী সাংবাদিক। সুজেট তখন সেই মেয়েটির পাশেই দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তরুণ এমন করে থাকলে তাঁর শাস্তি হওয়াই উচিত।
কিন্তু সুজেটের নিজের মামলা, পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ মামলার রায়দান তাঁর মৃত্যুতে পিছিয়ে যাবে না তো? ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মামলাটির চার্জ গঠন হয়েছিল। কলকাতার নগর দায়রা আদালতের দ্বিতীয় ফাস্টট্র্যাক আদালতে বিচারক মধুছন্দা বসুর এজলাসে মামলার বিচার চলছে। সরকারি আইনজীবী সর্বাণী রায় বলছেন, ‘‘এই মামলায় সুজেটের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে গিয়েছিল। তাই সুজেটের মৃত্যু এই মামলার বিচারে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’’ সুজেটের আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতাও দাবি করছেন, “সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মামলা দ্রুত গতিতেই শেষের দিকে এগোচ্ছে।” রায় বেরোতে আরও মাস দু’য়েক সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
এ দিনও সারদা মামলা লড়তে নগর দায়রা আদালতে এসেছিলেন সুজেটের আইনজীবী অনির্বাণবাবু। সেখানেই দাঁড়িয়ে সুজেটের সঙ্গে এত দিনের আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ করছিলেন। অনির্বাণের কথায়, ‘‘সুজেট খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিলেন। মাসখানেক আগেও আমার চেম্বারে এসেছিলেন। ও চেম্বারে আসা মানেই হাসি-আড্ডায় সে দিনের কাজ লাটে উঠত।’’ হাসিখুশি মানুষটির জন্য পদে পদে প্রতিকূলতা কিন্তু লেগেই থাকত। কিছু দিন আগেও অভিযোগ উঠেছিল, শহরের একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন সুজেট। লজ্জায় গুটিয়ে না গিয়ে আবারও শক্ত গলায় প্রতিবাদ জানাতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
এ দিন সুজেটের মৃত্যুর খবর চাউর হতেই নতুন করে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও আলি নামে আর এক যুবককে যে এখনও ধরা যায়নি, সেই প্রশ্নও সামনে আসে ফের। গোয়েন্দা দফতরের একটি সূত্র বলছে, ঘটনার পরেই কাদের মুম্বই পালিয়ে গিয়েছিল। একটি হোটেলে টলিউডের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে সে আশ্রয় নিয়েছে, খবর পেয়েছিল পুলিশ। পর দিন কলকাতা পুলিশের একটি দল হানা দিয়ে দেখে, কাদের ও তাঁর সঙ্গিনী হোটেল ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এ দিন লালবাজারের এক গোয়েন্দাকর্তা রীতিমতো আফশোসের বলছিলেন, ‘‘মাত্র চার ঘণ্টার ফারাকে কাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।’’ তার পর থেকে কাদের একাধিক বার ফোন নম্বর বদলাতে থাকে। তার গতিবিধি আঁচ করে যত বার হানা দিয়েছে, তত বারই ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। ইন্টারপোলও কিছু করতে পারেনি।
সুজেটের বন্ধুরা অবশ্য বলছেন, পুলিশের চোখে ধুলো দিলেও একটা জায়গায় হেরে বসে আছে কাদের। সুজেট খবরে এসেছিলেন ধর্ষিতা হিসেবে। সুজেট পৃথিবী ছাড়লেন প্রতিবাদের মুখ হয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy