বড়দিনের মেজাজ উপভোগ করতে ভিড় জমছিল সারাদিন ধরেই। সন্ধ্যার পরে তা বদলে গেল জনজোয়ারে। সোমবার, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
তালতলার বিফ রোস্টের সঙ্গে হাত ধরাধরি নতুনবাজারের কেশর ছানার পায়েসের। ঘরোয়া রসালো পর্ক সসেজের সঙ্গে গলাগলি চটপটা দই ফুচকা-ধোকলার।
যা মেলে ভারতে, তা মেলে এই পার্ক স্ট্রিটের জমায়েতে! সোমবার যেন দৃপ্ত স্বরে ঘোষণা করল বড়দিনের কলকাতা।
যিশুপুজোর লগ্নে বছরের শেষ সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনটাতেই কলকাতা আক্ষরিক অর্থে উৎসব-নগরী। আর আমুদে জনতার মহামিছিল বুঝিয়ে দিল, জাত-ধর্ম-রাজনীতির খোপ-কাটা ভাগাভাগি কতটা অবান্তর। বিকেলে পার্ক স্ট্রিটে বচ্ছরকার ‘ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যাল’-এ মেয়ে প্রেরণার সঙ্গে বিফ রোস্ট ভাগ করে খাচ্ছিলেন সোনি ওরফে পিয়ালি ঘোষ। সোনির স্বামী সিসিল ফিলিপ্স বাঙালি ক্রিশ্চান! বর ও মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মহিলা সহাস্যে বললেন, ‘‘আমি কিন্তু ধর্ম পাল্টাইনি! বাড়িতে বেস্পতিবার করে মা লক্ষ্মীর পুজোও করি। আমাদের বাড়িতে কোনও উৎসবই খাটো না।’’
আরও পড়ুন: রাতের ঢলেই বোধন মরসুমি বিশৃঙ্খলার
স্টলের উল্টো দিকে বিক্রেতা ফ্রান্সিস থমাসের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তিনি বলছিলেন, তুমুল চাহিদায় রাতভর জেগে পর্ক সসেজ বেঁধেছি। গত ২২ ডিসেম্বর পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্ক ও আশপাশে শুরু হয়েছে বড়দিনের উৎসব। চলবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম তিন দিনেই পাঁচ কেজি বিফ আর অন্তত ৫০০ সসেজ বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে ফ্রান্সিস হিসেব কষলেন। নতুনবাজারের সাবেক বাঙালি সন্দেশ ও ঘরোয়া ক্রিসমাস কেকের পসরার সামনেও সমান উৎসাহে হামলে পড়ল আনন্দ-নগরী!
রসনা-বিলাসের এই রঙিন ক্যানভাসের মতো গোটা কলকাতা জুড়েই ভিন্ন মেরুর হাত ধরাধরি। সম্প্রতি বাবার মৃত্যুর পরে মাকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার চেনা ক্লাবে বচ্ছরকার মধ্যাহ্নভোজে এসেছেন যোধপুর পার্কের দাশগুপ্ত দম্পতি। ক্লাব থেকে বেরিয়ে স্মার্টফোনে জনৈক জোব্বাধারী সান্তার সঙ্গে মায়ের ছবি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুত্র। উৎসবের আলো এ ভাবেই প্রলেপ দেয় ম্যাড়মেড়ে প্রাত্যহিকতার গায়ে।
একটু বাদে কাছেই পার্ক স্ট্রিটের আলো দেখতে হাজির হাবড়ার কলেজ প়ড়ুয়া ছেলেমেয়ে, তুতো ভাইবোনেদের দলটা। সকাল থেকেই পাতাল রেলের এসকালেটরে টলমলে অনভ্যস্ত মফস্সল! বিশেষ দিনে ছাপোষা ঘরের সপরিবার ট্যাক্সি-বিলাস পার্ক স্ট্রিট অবধি পৌঁছতেই গলদঘর্ম। আর সেই পার্ক স্ট্রিটের ভিড়ে মিশে গিয়েছে, অভিজাত ট্যুইড, টাই, উচ্ছ্বল কাঁধ-খোলা টপ কিংবা সস্তার জ্যাকেট-সোয়েটার। এই নরম শীতে কাউকেই বেখাপ্পা বলা যায় না মোটে।
শীতের দাক্ষিণ্য থেকে প্রকৃতিদেবী একেবারে বঞ্চিত করেননি কলকাতাকে। হাওয়া-অফিসের খবর, এ দিনের ১৪.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাটা অন্তত গত বড়দিনের থেকে কম ছিল খানিকটা। ক্রিসমাস ইভের থেকেও কিছুটা শীতলতর বড়দিন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মিলেনিয়াম পার্ক, গঙ্গার ঘাট থেকে নিকো পার্ক, ইকো-টুরিজম পার্ক— সর্বত্র শীত উদ্যাপনের ছবিটা নিজস্ব মহিমা ধরে রেখেছে। সর্বত্র ছদ্মবেশী সান্তাবুড়োদের ছড়াছড়ি। দিকে দিকে, আলো ঝলমল শিং বা লম্বা খরগোশের কান-বসানো সান্তা টুপিরও ছোটাছুটি। শহরের প্রতিটা মোড়ই এ দিন নিজস্বী-বিলাসীদের দখলে। কয়েক পা অন্তর সবই সেল্ফি-স্পট!
আজকের বড়দিনে সার্কাস বা ইডেনে টেস্ট ক্রিকেট-রোমাঞ্চ— কবেকার রূপকথা মনে হয়। পাড়ায় পাড়ায় কনফেকশনারি ও ঘরে কেক-কুকির ‘বেকার’দের ছড়াছড়িতে কেক নিয়ে সাবেক রোমাঞ্চও কি এক রকম? তবু চিড়িয়াখানা নিয়ে আবেগটা বাঙালিকে এখনও ছেড়ে যায়নি, তা এ দিন মালুম হয়েছে। বড়দিনে ৯৩ হাজার জনতার ঢল নেমেছিল আলিপুরের পশুপাখিদের বাগানে। প্রধান আকর্ষণ নবাগত সিংহ দম্পতি, জাগুয়ার দম্পতি ও ক্যাঙারু দম্পতি। পশুপাখি পরিবারের প্রবীণ সদস্য শিম্পাঞ্জি ‘বাবু’কেও দেখা গেল খোলতাই মেজাজে জনতার মনোরঞ্জনে ব্যস্ত।
সন্ধে ঘনালে সেই পার্ক স্ট্রিটের আলোই শহরের ‘সুপারস্টার’! যানবাহনহীন রাজপথ সকাল থেকেই স্রেফ পদাতিকদের দখলে। ঠিক হেভিওয়েট পুজোমণ্ডপের ভিড় সামলানোর মতোই ব্যারিকেড-দড়ির সাহায্যে পথ চলাচল নিয়ন্ত্রণের লাগাম নিয়েছে পুলিশ। পার্ক স্ট্রিটে ঢোকার মুখটাই রণক্ষেত্রের ব্যূহের মতো সাজো-সাজো।
কিড স্ট্রিটের দিক থেকে হেঁটে ভিতরে ঢোকা যাবে কিংবা রাসেল স্ট্রিটের দিক ধরে বেরোতে হবে— সব পরিকল্পনামাফিক মাপা পথচলা। কিন্তু সাবেক কেকের দোকান না সুখাদ্যের মেলা, কফিশপ না পানশালা— কোথায় প্রধান আকর্ষণ তার ঠিক-ঠিকানা নেই। উচ্ছ্বাসে ভাসা জনস্রোত কখনও নিজস্বীর টানে থমকে যাচ্ছে, কখনও এগোচ্ছে তার নিজের গতিতে।
এই যেমন খুশি চলো বা যেমন খুশি বাঁচোর মেজাজটাই বড়দিনের কলকাতার মূল সুরটা বেঁধে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy