Advertisement
১১ জুন ২০২৪

শেখা হয়নি সাতে, সাধ মিটছে সত্তরে

ঠাকুরপুকুরের তপন আর দেবী সেনগুপ্ত চুটিয়ে সিন্থেসাইজার শিখে ঘরোয়া অনুষ্ঠান মাত করে দিচ্ছেন। কাঁকুড়গাছির প্রীতি মুখোপাধ্যায় মেয়ের কাছে আমেরিকায় গিয়ে ইংরাজিতে কথা বলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন।

শিক্ষানবিশ: বয়স কেবল সংখ্যা, প্রমাণ দিচ্ছেন এঁরা। নিজস্ব চিত্র

শিক্ষানবিশ: বয়স কেবল সংখ্যা, প্রমাণ দিচ্ছেন এঁরা। নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৭ ০৯:০০
Share: Save:

মেডিসিন-এ নোবেলজয়ী আমেরিকান মহিলা বিজ্ঞানী রোজালিন এস ইয়ালো বলেছিলেন— ক্রমাগত জানা ও শেখার উত্তেজনার ভিতরেই আসলে লুকিয়ে রয়েছে তরুণ থাকার চাবিকাঠি। শেখার খিদে ফুরিয়ে গেল মানেই মানুষ বুড়ো হয়ে গেল।

রোজেলিন জন্মেছিলেন ১৯২১-এ। সে যুগে ৫০ বা ৫৫ পার হলেই বার্ধক্যের যুক্তি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, নতুন করে শেখা থেকে দূরে রাখার একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল। যুগের থেকে মানসিকতায় এগিয়ে থাকা রোজেলিনের মতো কেউ-কেউ কিন্তু অন্য ভাবে জীবনটাকে দেখেছিলেন। সেই দেখাটাতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন বহু মানুষ। বিদেশে তো বটেই, এমনকী এ দেশেও।

‘‘মরতে বসেছি এখন আর শিখে কী হবে’’ গোছের বস্তাপচা ধারণাকে গুঁড়িয়ে ষাটের পরে তাঁরা নতুন করে নতুন কিছু শেখা শুরু করছেন। তাঁদের নিজেদের কথায় যা অনেকটা ‘নতুন ইনিংস শুরু’ করার মতো। এই কলকাতা শহরেও এখন এমন উদ্যমী, শিক্ষানবিশদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ৬৫, ৭১ এমনকী ৮৩ বছর বয়সেও যাঁরা নাচ শিখছেন, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস করছেন, সিন্থেসাইজার বাজানো বা কম্পিউটর শিখছেন দুরন্ত আগ্রহে। বয়স বা ‘লোকে কী বলবে’-র সঙ্কোচে কম্পিত নয় তাঁদের অনন্ত সবুজ হৃদয়।

‘‘এখনকার নতুন জেনারেশন যেমন কোনও কিছুর পরোয়া করে না, তেমন আমরা হলাম আধুনিক প্রবীণ জেনারেশন। আমরাই বা কেন শেখার ব্যাপারে লোকের কথার পরোয়া করব?’’—হাসতে হাসতে বলছিলেন নিউ-আলিপুরের বাসিন্দা বছর পঁয়ষট্টির নন্দিতা দাস। বছরখানেক হল পুরোদমে কম্পিউটার আর গান শিখছেন নন্দিতা। গল্ফগ্রিনের বাসিন্দা সন্ধ্যা চৌধুরী আবার ৭৫ বছর বয়সে কম্পিউটর শিখে আমেরিকাবাসী ছেলেকে ই-মেল করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

ঠাকুরপুকুরের তপন আর দেবী সেনগুপ্ত চুটিয়ে সিন্থেসাইজার শিখে ঘরোয়া অনুষ্ঠান মাত করে দিচ্ছেন। কাঁকুড়গাছির প্রীতি মুখোপাধ্যায় মেয়ের কাছে আমেরিকায় গিয়ে ইংরাজিতে কথা বলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। বাগুইআটির বাসিন্দা ৬৪ বছরের অপর্ণা রায় অস্টিওআর্থ্রাইটিসকে ‘পায়ের ভৃত্য’ করে দুর্দান্ত রবীন্দ্রনৃত্য শিখেছেন। ফেসবুকে তাঁর নাচের অনুষ্ঠান আপলোড করে দিয়েছেন গর্বিত স্বামী। লাইকের বন্যায় আপাতত তিনি ভেসে যাচ্ছেন। ‘‘বুড়ো বয়সের উদ্ভট শখ’ বলে কোনও ব্যঙ্গ কোথাও শুনতে হয়নি, বরং উৎসাহ পেয়েছেন। গিরিশ পার্কের দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় আটাত্তর বছর বয়সে চাইনিজ রান্না শিখে মেলায় স্টল দিয়ে এমন কামাল করেছেন যে, পুজোর সময় স্টল দেওয়ার জন্য পাড়ার পুজোকমিটি ঝুলোঝুলি করছে।

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, আগে মানুষের জগত ছিল ছোট। বয়স্করা পুজোআচ্চা, নাতিনাতনি, পাড়ায় একটু আড্ডা আর স্মৃতিচারণায় সীমাবদ্ধ থেকে যেতেন। কিন্তু ইন্টারনেট এবং বিশ্বায়নের যুগে প্রবীণেরাও বিভিন্ন উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শিখছেন। নিজেকে ভালবেসে নিজের ভালবাসার জিনিস নিয়ে আনন্দে থাকতে শিখছেন। বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বয়স্ক মানুষেরা নতুন কিছু শিখতে পারবেন না এই ধারণাটা হল ‘এজিজম’। এটা ‘রেসিজম’ এর মতো একটা নেতিবাচক ধারণা। যে কোনও বয়সে মানুষ ‘স্কিল জেনারেট’ করতে পারে। নতুন কিছু শিখতে গিয়ে মানুষ অন্য অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়, যুক্ত হয়। নতুন বন্ধু হয়। তারা সুখদুঃখ ভাগ করে নেয়। বাঁচার নতুন মানে খুঁজে পায়।’’

দক্ষিণ কলকাতায় প্রবীণদের বিভিন্ন রকম নতুন জিনিস শেখানোর একটি সংস্থার পরিচালক অপ্রতিম চট্টোপাধ্যায় জানান, লন্ডন থেকে ‘ইউথ্রি-এ’ নামে একটি আন্দোলন গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতও তার মধ্যে রয়েছে। যার মূল কথাই হল ‘সারা জীবন ধরে শেখা।’ এত দিন যা শিখতে পারিনি, জানার সুযোগ পাইনি, তা শিখবো বুড়ো হয়েই। কারণ, জীবনের এই ‘রুপোলী অধ্যায়’-ই শেখার সোনালী সুযোগ এনে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE