Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

রেষারেষি দেখলে আজও আতঙ্কে ভোগেন প্রৌঢ়

দশ বছর আগে বাসের রেষারেষিতেই একসঙ্গে কাটা গিয়েছিল স্বামী-স্ত্রী, দু’জনের ডান হাত। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখেছিল তাঁদের চার বছরের ছেলে।

লড়াকু: বাড়িতে ছেলের সঙ্গে বরুণবাবু। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

লড়াকু: বাড়িতে ছেলের সঙ্গে বরুণবাবু। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৯ ০২:৪৩
Share: Save:

রেষারেষি দেখলে এখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না তিনি। বাসের ভিতরেই চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘তোমাদের কি শিক্ষা হয় না? আবার কারও হাত কাটা পড়বে! যেমন আমার হাতটা কেটেছে!’

এমন ক্ষোভ উগরে দেওয়ার সময়েও অবশ্য প্রৌঢ়ের ডান হাতের তর্জনী ওঠে না। কারণ, দশ বছর আগে বাসের রেষারেষিতেই একসঙ্গে কাটা গিয়েছিল স্বামী-স্ত্রী, দু’জনের ডান হাত। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখেছিল তাঁদের চার বছরের ছেলে।

২০০৯ সালের ২৫ অগস্ট। সেই দিনটার স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় পর্ণশ্রীর বরুণ চক্রবর্তীকে। তাই বাসে উঠে চালককে রেষারেষি করতে দেখলেই আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠেন যাদবপুরের ‘রিজিয়োনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিন্টিং টেকনোলজি’র গ্রন্থাগারিক। যেমনটা করেছিলেন বৃহস্পতিবার সকালেও। বরুণবাবু জানালেন, দেশপ্রিয় পার্ক থেকে লেকের দিকে যাওয়ার সময়ে তাঁদের বাস আর একটি বাসের সঙ্গে রেষারেষি করছিল। যা দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন অফিসযাত্রী ওই প্রৌঢ়। বললেন, ‘‘যতই বলি, কেউ শিক্ষা নেয় না। রেষারেষি করলে অন্তত ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা দরকার।’’

সে দিন সকালেই হরিদেবপুরে এক বাসযাত্রীর হাত কাটা যায়। বিকেলে পর্ণশ্রীর দোতলা বাড়ির ড্রইংরুমের সোফায় বসে বাঁ হাতে জামার বোতাম আটকানোর ফাঁকে খবরটা শুনে কিছু ক্ষণের জন্য চুপ করে গেলেন ওই প্রৌঢ়। পরে শুধু বললেন, ‘‘আবার হাত কাটা গেল!’’

দেওয়ালে টাঙানো স্ত্রী জয়শ্রীর ছবি। সে দিকে তাকিয়ে বরুণবাবুর আক্ষেপ, ‘‘কেন যে সে দিন প্রথম বাসটা ও ছেড়ে দিয়েছিল।’’ জানালেন, স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন হাওড়ায়। স্ট্যান্ডে পৌঁছে বাস পেলেও একটি মাত্র প্রতিবন্ধী আসন খালি থাকায় তাতে ওঠেননি জয়শ্রীদেবী। পরের বেহালা-হাওড়া মিনিবাসে উঠে জানলার ধারের পরপর দু’টি আসনে বসেছিলেন ওই দম্পতি। ছেলে শুভদীপ ছিল বরুণবাবুর কোলে। বাস ছাড়ার পর থেকেই চলছিল রেষারেষি। ডাফরিন রোডে আচমকাই আর একটি বেসরকারি বাস বরুণবাবুদের মিনিবাসের পেটে ধাক্কা মেরে ঢুকে গিয়েছিল।

গলা বুজে আসে প্রৌঢ়ের। কোনও মতে বলেন, ‘‘ছেলেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ডান হাতটা থেঁতলে গিয়ে মাংসপিণ্ড-সহ কব্জিটা পায়ের সামনে পড়েছিল। আর জয়শ্রীর হাতটা তিন টুকরো হয়ে পড়েছিল রাস্তায়। তবে দুই পুলিশকর্মী তরুণ মাইতি ও রাজীব দাসের জন্য সে দিন প্রাণটা বেঁচেছিল।’’ টানা চার মাস এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েই স্বামী-স্ত্রী মিলে বাঁ হাতে লেখার অভ্যাস করেছিলেন। আজ ডান হাতের মতোই বাঁ হাতে অবিকল লিখতে পারেন বরুণবাবু। জানালেন, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী ও যুগ্ম কমিশনার নীরজকুমার সিংহের চেষ্টায় ২০১১ সালে কৃত্রিম হাত পেয়েছিলেন। প্রৌঢ় বলেন, ‘‘বড্ড ভারী ওই হাত নিয়ে বাসে-ট্রামে চড়া যায় না। তাই ব্যবহার করি না। আর ব্যাটারির দামও অনেক।’’

২০১৫ সালে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে কৃত্রিম হাত পেয়েছিলেন জয়শ্রীদেবীও। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬-তে তাঁর মৃত্যুর পরে হাতটি দান করে দিয়েছেন বরুণবাবু। দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে এখনও মামলা চলছে। প্রৌঢ় বলেন, ‘‘আলিপুর আদালতের রায়ে আমি খুবই সামান্য ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। তাই ফের হাইকোর্টে মামলা করেছি। আর স্ত্রীর বিষয়ে কোনও ক্ষতিপূরণ মেলেনি। সেই সংক্রান্ত মামলাও হাইকোর্টে চলছে।’’

স্মৃতি আঁকড়ে লড়াইয়ের মাঝেই ছেলেকে ‘ভয়’ জয় করার পরামর্শ দেন বরুণবাবু। কারণ, হাত কাটার দৃশ্য আর মায়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারে না শুভদীপ। ভয় পায় বাসে চাপতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Rash Driving Bus Old man
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE