শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে অশোক চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র।
খোঁজ মিলেছে তাঁর পরিজনেদের। তাঁদের কেউ রয়েছেন বিদেশে, কেউ বা দেশে। অনেকেই জানিয়েছিলেন, সাধ্যমতো ব্যবস্থা করবেন তাঁরা। তার পরে সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও সেই অস্ট্রেলীয় নাগরিক, বৃদ্ধ অশোক চক্রবর্তীর ঠিকানা এখনও সেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল।
সংবাদপত্রে অশোকবাবুর খবর দেখে কার্যত হতবাক তাঁর এক সময়ের সহকর্মী তথা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। দীর্ঘ দিন ধরেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই অশোকবাবুর। তাঁদের কাছে অশোকবাবু বরাবরের ‘ব্রাইট বয়’। সেই তিনিই যে এখন স্মৃতিভ্রষ্ট, তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। সোমবার তাঁরা হাসপাতালে গিয়ে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরাই অসহায় পুরনো সহকর্মীর পাশে দাঁড়াতে চান।
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২ ডিসেম্বর পুলিশ ওই বৃদ্ধকে প্রায় অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে এনে ভর্তি করে। পুলিশ জানিয়েছিল, রাস্তার ধারে পড়ে ছিলেন অশোকবাবু। অনাহার ও অপুষ্টির জেরে শরীর ছিল অসম্ভব দুর্বল। কয়েক দিনের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হন তিনি। অশোকবাবুর সঙ্গে থাকা ব্যাগে তাঁর অস্ট্রেলীয় পাসপোর্ট পাওয়া যায়।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাব’-এর সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস কলকাতার অস্ট্রেলীয় দূতাবাসকে বিষয়টি জানান। দূতাবাস নিশ্চিত করে যে, অশোকবাবু তাঁদের দেশেরই নাগরিক। অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাঙালি, বিজ্ঞানী গোরাচাঁদ ঘোষ সিডনিতে অশোকবাবুর স্ত্রী-কন্যাকে খুঁজে বার করেন।
অশোকবাবুর ‘প্রাক্তন’ স্ত্রী জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ দিন আগেই তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। তবে মানবিকতার খাতিরে অশোকবাবুর জন্য তাঁরা কিছু করতে চান। শিলিগুড়িতে খোঁজ মিলেছিল অশোকবাবুর ভাই সৌমিত্র চক্রবর্তীর। অশোকবাবুর প্রাক্তন স্ত্রী জানিয়েছিলেন, সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে তাঁরা কিছু করতে চান। তার পরে এক সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালে ফোন করে অশোকবাবুর খোঁজ নেননি তাঁদের কেউ। ফলে বৃদ্ধের ঠিকানা এখনও সেই হাসপাতাল। অম্বরীশবাবু বলেন, “সৌমিত্রবাবু বলেছেন, শারীরিক কারণে তিনি দাদাকে দেখতে আসতে পারবেন না। আর আর্থিক কারণে তাঁর পক্ষে দাদার দায়িত্বও নেওয়া সম্ভব নয়।”
সংবাদপত্রে অশোকবাবুর খবর এবং ছবি দেখে চিনতে পারেন তাঁর এক সময়ের সহকর্মী সুশান্ত পাল। তাঁরা একসঙ্গে দীর্ঘ দিন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করেছেন। অশোকবাবুর এমন পরিণতি দেখে হতবাক সুশান্তবাবু। তিনিই অন্য সহকর্মীদের বিষয়টি জানান। সুশান্তবাবু বলেন, “অশোক অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। কিন্তু বরাবরই একটু খেয়ালি প্রকৃতির ছিল। ডাক্তারি পড়ার সময়ে ওর বাবার মৃত্যু হয়। তার পরে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢোকে। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। একসঙ্গে কর্মচারী ইউনিয়ন করেছি দীর্ঘ দিন।”
সুশান্তবাবু জানান, উত্তরপাড়ায় ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে অস্ট্রেলীয় প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে অশোকবাবুর বিয়ে হয়। সেই বিয়েতেও আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সুশান্তবাবুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন অশোকবাবু। সেখানেও একটি ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। বছর দশেক আগে দেশে ফিরে সুশান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন অশোকবাবু। তাঁর বাড়িতেও গিয়েছিলেন।
সুশান্তবাবু বলেন, “ওর সঙ্গে জনা দুই যুবক ছিল। তারা একসঙ্গে কিছু একটা ব্যবসা করবে বলে জানিয়েছিল। উত্তরবঙ্গে জমি কেনার পরিকল্পনাও ছিল ওদের। ওই পর্যন্ত জানতাম। পরে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ পেয়েছি। শেষ পর্যন্ত কাগজে ওর ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম।” বাড়ি বিক্রির টাকা এবং অশোকবাবুর সঞ্চিত টাকা কোথায় গেল, তার কোনও হদিস এখনও মেলেনি। অশোকবাবুর পরিবারের কেউ পুলিশে অভিযোগও জানাননি।
সোমবার হাসপাতালে গিয়ে অশোকবাবুর সঙ্গে কথা বলেন সুশান্তবাবু এবং তাঁদের আর এক সহকর্মী। সুশান্তবাবু বলেন, “অপুষ্টিতে ওর অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক কিছুই মনে করতে পারছে না। তবে আমাদের চিনতে পেরেছে। এমনকি, পুরনো সহকর্মীদের নামও বলেছে। আমরা বন্ধুরা মিলে ওর জন্য কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। একটা মানুষ এই ভাবে শেষ হয়ে যাবে, ভাবতে পারছি না। টাকার ব্যবস্থা না হয় করে দেব। এখন ওর পরিচিত কেউ যদি দেখভালের দায়িত্ব নেয়, ভাল হয়। কারণ আমরাও তো অশক্ত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy