রসায়নে দু’বার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কে ব্যারি শার্পলেস। ফাইল চিত্র।
কৃতী গবেষক অনেক দেখেছেন। কিন্তু কার্ল ব্যারি শার্পলেসের মতো বর্ণময় চরিত্রের বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে কমই এসেছেন শান্তনু ভট্টাচার্য। দেশের অন্যতম বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (আইএসিএস)-এর প্রাক্তন অধিকর্তা শান্তনু একদা আমেরিকায় ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ (এমআইটি)-তে শার্পলেসের গবেষণায় সহযোগিতা করেছিলেন। সেই সুবাদে আমেরিকার এই কৃতী রসায়নবিদকে খুব কাজ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের ‘সিনিয়র প্রফেসর’ শান্তনু বুধবার জানান, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত এমআইটিতে আর এক নোবেলজয়ী জীবরসায়নবিদ ভারতীয় বংশোদ্ভূত হরগোবিন্দ খোরানার তত্ত্বাবধানের গবেষণার কাজ করেছিলেন তিনি। শার্পলেসও সে সময় ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানে। গবেষণা সংক্রান্ত কাজের কারণে শার্পলেসকে ঘনিষ্ঠ ভাবে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন, ল্যাবরেটরিতে কাজের পাশাপাশি সাঁতার এবং র্যাফটিংয়েও অদম্য উৎসাহী ওই বিজ্ঞানী। এমনকি, পরবর্তী সময় এমআইটি ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার চলে যাওয়ার ‘কারণ’ জানাতে গিয়ে শান্তনুকে শার্পলেস বলেছিলেন, ‘‘এখানে তো সমুদ্র নেই। সমুদ্রের হাওয়া না পেলে আমার ভাল লাগে না।’’
আমেরিকার ক্যারোলিন আর বার্তোজ্জি এবং ডেনমার্কের মর্টেন মেলডালের পাশাপাশি ২০২২ সালের রসায়নে নোবেলজয়ী হিসাবে বুধবারই শার্পলেসের নাম ঘোষণা করেছে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। এর আগে ২০০১ সালেও রসায়নেই নোবেল পেয়েছিলেন শার্পলেশ। ১৯০১ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে রসায়নে এই নিয়ে মোট ১১৬ জন রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জন দু’বার করে রসায়নে এই সম্মাননা পেলেন। ১৯৫৮ এবং ১৯৮০ সালে রসায়নে দু’বার নোবেল সম্মাননা পাওয়ার রেকর্ড ছিল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক স্যাঙ্কারের। এ বার সেই রেকর্ড ছুঁয়ে ফেললেন শার্পলেস।
শান্তনু জানাচ্ছেন, ২০০১ সালে একটি বিশেষ অনুঘটকের সাহায্যে সহজে কোনও অণুকে সক্রিয় করে ‘প্রতিবিম্ব’ (মিরর) গঠনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন শার্পলেস। সেই সূত্রেই প্রথম বার রসায়নে নোবেল জয়। তিনি বলেন, ‘‘উদাহরণ হিসাবে বলা যায় লিমোনিন এস-আইসোমার এবং আর-আইসোমারের কথা। রাসায়নিক গঠনগত ভাবে এক প্রকার হলেও তাদের একটি পাতিলেবু এবং অন্যটি কমলালেবুর গন্ধবিশিষ্ট। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও ফারাক রয়েছে।’’ বিভিন্ন ভিটামিন এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রস্তুত করতে এমন প্রতিবিম্ব অণুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বার আমেরিকার রসায়নবিদের নোবেল প্রাপ্তির কারণ ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ সংক্রান্ত গবেষণা। ষাটের দশকের গোড়ায় জার্মানির রসায়নবিদ রোল্ফ হুইগসেন এ সংক্রান্ত গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। তাকেই নতুন মাত্রা দিয়েছেন শার্পলেস। তামার অণুতে অ্যাজাইড-অ্যালকাইন চক্রীয়-সংযোজনে (হেটেরোসাইক্লো অ্যাডিশন) সাফল্য পেয়েছেন তিনি। অণু জোড়ার সেই গবেষণায় শার্পলেসের সহকারীর ভূমিকায় ছিলেন শান্তনু। অণু জুড়ে শৃঙ্খল তৈরির ওই কৌশল যে তামার পাশাপাশি জীবকোষেও ঘটানো সম্ভব, এ বারের আর এক নোবেলজয়ী ক্যারোলিন বার্তোজ্জি তা দেখিয়েছেন।
শান্তনু জানিয়েছেন, শার্পলেসের বাবা ছিলেন ফিলাডেলফিয়ার নামী শল্যচিকিৎসক। চেয়েছিলেন ছেলেও তাঁরই পেশাতে আসুক। কিন্তু ছোট থেকেই রসায়নের প্রতি ছিল তাঁর অদম্য উৎসাহ। তাই সেই পথই বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা। তার পর এমআইটি এবং স্ট্যানফোর্ডে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজ। এমআইটিতে ১৭ এবং স্ট্যানফোর্ডে ৩ বছর ছিলেন শার্পলেস। এর পর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোর স্ক্রিপস ক্লিনিকে চলে গবেষণার কাজ। সেখান থেকেই এসেছে নোবেল। তাঁর এই গবেষণা ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিক-সহ নানা নতুন ওষুধ আবিষ্কারে দিশা দেখাতে পারে বলে রসায়নবিদেরা মনে করছেন।
শান্তনু বলেন, এমআইটিতে উনি (শার্পলেস) বার বার আমাদের বলতেন, ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় ‘সেফটি গগল্স’ পরার কথা। আসল কারণটা পরে জেনেছিলাম। সত্তরের দশকে এক বার মুহূর্তের অসতর্কতায় টেস্ট টিউব ফেটে তাঁর দু’টি চোখ মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছিল। একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন চিরতরে। ভাগ্যিস দ্বিতীয় চোখটি বেঁচে গিয়েছিল। রসায়নে জো়ড়া নোবেল জয় এসেছে তো সেই একটি চোখের পর্যবেক্ষণেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy