সংস্কারের পরে এই ওল্ড কারেন্সি ভবনের গ্যালারির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক সফরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে কলকাতা বন্দরের নামকরণ ঘোষিত হওয়ায় বিতর্ক তো হচ্ছেই। এর পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন ভবনের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে কলকাতার ঐতিহ্য তুলে ধরার কথা বলেছেন, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
সংস্কারের পরে গত শনিবার ওল্ড কারেন্সি ভবন, মেটকাফ হল, জাতীয় গ্রন্থাগারের বেলভেডিয়ার হাউস-সহ একাধিক ভবনের গ্যালারির উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব দেশে-বিদেশে সবার সামনে তুলে ধরব। আমি বলব, যাঁরা কলকাতায় আসবেন, তাঁরা ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং, মেটকাফ হল, বেলভেডিয়ার (জাতীয় গ্রন্থাগার) ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অবশ্যই দেখুন।’’ যার প্রেক্ষিতে বিদ্বজ্জনদের একাংশের মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে উনিই কলকাতার ইতিহাসের কাণ্ডারি।
কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিকের মতে, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কলকাতার ঐতিহ্য নিয়ে যে ভাবে মন্তব্য করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে এত দিন এ শহরের ঐতিহ্য নিয়ে কোনও কাজই হয়নি। যেন সেই কাজের সূত্রপাত হচ্ছে তাঁর হাত ধরে। মোদী তো কলকাতার ঐতিহ্যের মুখপাত্র নন!’’ হেরিটেজ স্থপতিরা জানিয়েছেন, মেটকাফ হল, ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং-এর কাজ দীর্ঘ দিন ধরেই চলছিল। হেরিটেজ স্থপতি হিমাদ্রি গুহ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যে ভবনগুলির কথা বলেছেন, সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। ফলে তা নিয়ে তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, ওই ভবনগুলি সংস্কারের কাজ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ঘটনাচক্রে বর্তমান সরকারের আমলে সেই কাজ শেষ হয়েছে।’’
মোদীর মন্তব্য শুনে ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় আবার বলছেন, ‘‘লর্ড কার্জনের সময়ে শহরে যে ক’টি উল্লেখযোগ্য ভবন ছিল যা পরবর্তী কালে হেরিটেজ ঘোষিত হয়, সেগুলি সংস্কারের কাজ তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। তার পরে বিভিন্ন সময়ে সেই সংস্কারের কাজ চলেছে। ভিন্ রাজ্য থেকে যাঁরা কলকাতায় আসেন, তাঁরা বরাবরই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-সহ এই সব হেরিটেজ ভবন ঘুরে দেখেন। ফলে আলাদা ভাবে সেগুলি দেখার কথা বলা অর্থহীন।’’
মোদীর এই মন্তব্য ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায়’ এসে এখানকার ঐতিহ্যে ভাগ বসানোর চেষ্টা বলে মনে করছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। কমিশনের আধিকারিকদের অধিকাংশের মতে, শহরের বা বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে কাজ করছেন তাঁরা। তাই এমন মন্তব্য করে শহরের ঐতিহ্যের মুখপাত্র হওয়ার ‘ব্যর্থ’ চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী। কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘মোদী কলকাতা সম্পর্কে কতটুকু জানেন? এই শহরের গড়ে ওঠা, এর ইতিহাস, কতটা জানা আছে তাঁর? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি কিছু ঘোষণা করতেই পারেন। কিন্তু তাতে ঐতিহ্যের নেপথ্যে তাঁর কৃতিত্ব প্রমাণিত হয় না।’’ শুভাপ্রসন্নের আরও দাবি, ‘‘রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই মোদী এমন সব জায়গায় কর্মসূচি নিয়েছিলেন, যার সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িত। কিন্তু বাঙালিকে বিভ্রান্ত করা সহজ নয়।’’
তবে প্রধানমন্ত্রীর এ হেন মন্তব্যে আশ্চর্যের কিছু দেখছেন না শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, ক্ষমতায় এসে সকলেই এমন করে থাকেন। কিন্তু শুধুমাত্র নির্বাচনের ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সৌরীনবাবুর কথায়, ‘‘ঐতিহ্য নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ যে আমলে কাজ শেষ হয়, তার কৃতিত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারই দাবি করে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে বলে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করছে বা এমন ভাবে কথা বলছে, যা
গণতন্ত্রের পরিপন্থী।’’
কলকাতার নিজস্ব পরিচয় এক দিনে গড়ে ওঠেনি। শহরের ইট-পাথরে তিলতিল করে গড়ে উঠেছে সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য। কোনও জনপ্রতিনিধি, তা তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও ক্ষণকালের সফরে এসে সেই ঐতিহ্যের দাবিদার হতে পারেন না— এই মত অনেকেরই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy